সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
জুলাই ২০, ২০২০
মাত্র ১৪ বছর বয়সে ইডেনে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অভিষেক ঘটেছিল জাতীয় দলের হয়ে। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। বাংলা থেকে রেল দলে খেলেছেন। ১৯ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য হয়েছেন। আজও মহিলা টেস্টে ভারতের হয়ে প্রথম উইকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড জুটিতে তাঁর নাম জ্বলজ্বল করে। আজও টেস্টে ৯ রানে ৬ উইকেট, এক ইনিংসে ভারতের হয়ে দ্বিতীয় সেরা। প্রায় দু'যুগ আগে খেলা থেকে অবসর নিলেও কোচিং ও ক্রিকেট প্রশাসনে যুক্ত গার্গী ব্যানার্জি আজ ৬০ বছর বয়সে পড়লেন।
প্রশ্ন : কিভাবে ওয়াই ডব্লু সি এ থেকে ক্রিকেটে এলেন বলুন। আপনি তো ফুটবলও খেলতেন !
গার্গী : আমি এত দস্যি ছিলাম যে আমাকে বাড়ি থেকে ওয়াই ডব্লু সি এ-তে ভর্তি করিয়ে দেয়। সেখানে বাস্কেটবল আর টেবল টেনিস খেলতাম। একদিন বাস্কেটবল কোচ অরিজিৎদার মুখে মেয়েদের ক্রিকেট দল হচ্ছে জানতে পেরে বাবাকে বললাম। বাবা কালীঘাট মাঠে নিয়ে গেল। ট্রায়ালে ব্যাট বল ফিল্ডিং কিছুই করতে পারিনি, কিন্তু সুযোগ পেয়ে যাই ১৬ জনের দলে। তখন বাবা বললো, ভালোভাবে না শিখে জাতীয় স্তরে যাওয়া উচিত নয়। আমি খুব কান্নাকাটি করছিলাম। বাবা তখন দেশপ্রিয় পার্কে পুলকদা (বিশ্বাস) এর নিয়ে গেলেন। উনি আমাকে কার্তিক (বসু) দার কাছে নিয়ে যান। একবছর প্র্যাকটিস করে তারপর আবার ট্রায়াল দিয়ে ১৯৭৫/৭৬ মরশুমে বাংলা দলে সুযোগ পাই। দু'বছর পরে ভারতীয় দলে।
প্রশ্ন : মাত্র ১৪ বছর ১৬৫ দিন বয়সে বিশ্বকাপে ইডেনের মতো মাঠে অভিষেক ! কি মনে হচ্ছিল ?
গার্গী : সত্যি বলতে কি কোনো অনুভূতিই হয়নি। ১৪ বছর বয়স তো। কি আর বুঝবো। খুশি হয়েছিলাম ভারতীয় দলে সুযোগ পেয়ে। পরে সিনিয়রদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে বুঝতে পারি এ এক বিশাল কীর্তি।
প্রশ্ন : আপনার বোলিং স্ট্রাইক রেট টেস্ট ম্যাচের ক্ষেত্রে ভারতীয় দের মধ্যে হরমনপ্রীত কৌরের পরেই। অথচ আপনি বল কম করতেন। কেন ?
গার্গী : আমি তো স্টক বোলার ছিলাম। আমার কোচ আমায় বোলার করে দেন। বলে আমি কম করতাম, যখনই করতাম উইকেট পেতাম।
প্রশ্ন : দীর্ঘদিন বাংলা ও রেলের হয়ে খেলে বহুবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। আজ বাংলা আবার লড়াই করছে জায়গা ফিরে পাওয়ার জন্য। কিন্তু রেল আগের থেকে অনেক দূর্বল হয়ে গেছে। কেন ?
গার্গী : আমি ১৯৭৫-৮৪ বাংলার হয়ে ৭ বার আর ১৯৮৫-৯৮ রেলের হয়ে ১২ বার, মোট ১৯ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। বাংলা একটু ধারাবাহিকতা দেখালে অনেক দূর এগোবে। কিন্তু রেল আরো দুর্বল হবে। মিতালী রাজ আর পুনম রাউত চলে গেলে আর কেউ নেই। শেফালী ভার্মা একা কত টানবে! একসময়ে ভারতীয় দলের সব সদস্য ইনক্লুডিং ম্যানেজার পুরোটাই রেল থেকে হতো। একসাথে এতজনের বেরিয়ে যাওয়ার ধাক্কা সামলানো কঠিন।
প্রশ্ন : এখনও প্রথম উইকেটে ১৫৩ টেস্টে ভারত সেরা, এখনও ৯ রানে ৬ উইকেট টেস্টে ভারতের দ্বিতীয় সেরা। কিছু বলুন এই দুটো ম্যাচ নিয়ে।
গার্গী : বম্বে টেস্টে সন্ধ্যা আগরওয়ালের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৫৩ রানের জুটি গড়েছিলাম। সেইদিন ম্যাচের আগে যখন সকালে নকিং করছি, আমার ব্যাটিং দেখে সেলিম দুরানি ওপর থেকে নেমে আসেন। মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বলেন 'বেটা তু বহত দূর জায়েগী, তেরা ব্যাটিং বহত আচ্ছা হ্যায়'। এটা অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল। একসময় হাফ সেঞ্চুরির পরে মনে হচ্ছিল আমি সেঞ্চুরি করতে পারি। কিন্তু হয়নি। আসলে আমরা কোনোদিন রেকর্ডের কথা ভেবে খেলিনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল মহিলা ক্রিকেটের উন্নতি।
আর ৯ রানে ৬ উইকেট এক্সট্রা-অর্ডিনারি বোলিং হয়েছিল। এত স্পিন করবে ভাবতে পারিনি। ব্যাটসম্যানরা খেলতে না পেরে অধৈর্য হয়ে হিট উইকেট করে আউট হয়েছে। কিন্তু এটা যে পর্যায়ের সাফল্য, সেই পর্যায়ের পরিচিতি আনেনি।
প্রশ্ন: ১৯৮৬ ইংল্যান্ড সফরে একটা টেস্টে দু' ইনিংসে হাফ সেঞ্চুরি। কিছু যদি বলেন এই ব্যাপারে।
গার্গী : ওই ম্যাচের ৭৫ রানটা নিখুঁত ভাবে করেছিলাম। সকাল থেকে টি এর একঘন্টা আগে অবধি খেলি। একটা বল পায়ে লাগেনি। সন্ধ্যাকে বলেছিলাম, তুই সঙ্গে থাকলে ১০০ করবো। কিন্তু টি এর একঘন্টা একটা শর্টপিচ বল অফ স্ট্যাম্পের বাইরে কাট করতে গিয়েছিলাম গালি আর পয়েন্টের মধ্যে দিয়ে। কারণ স্লিপ আর পয়েন্টের মধ্যে যে দাঁড়িয়ে ছিল ও বাঁ-হাতি। ওর ডান দিক থেকে মারলে বেরিয়ে যাবে ভেবেছিলাম। বলটা ওর ডান হাতের তিন আঙুলে আটকে গেল।
আসলে সন্ধ্যা খুব স্লো খেলতো। ফলে রিস্ক আমাকে নিতে হতো। বোম্বেতে আমি যখন ৭১ করে আউট হই, ও তখন ৩০ এর ঘরে। পরের দিন সেঞ্চুরি করে।
প্রশ্নঃ কিছুদিন আগে এ সি এস মেয়েদের ক্রিকেটে প্রথম শ্রেণি এবং ঘরোয়া একদিনের ম্যাচকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু ভারতে বহু ম্যাচের স্কোর পাওয়া যায় না। আপনারা এইগুলি পুনরুদ্ধার করার কি ব্যবস্থা নিচ্ছেন ?
গার্গী : বহু চেষ্টা হয়েছে। বাংলার অবস্থা শোচনীয় অন্য রাজ্যের থেকে। পূর্বতন মহিলা ক্রিকেট সংস্থার কর্মকর্তা , সম্পাদকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কিছু জোগাড় করা যায়নি। বিভিন্ন খেলোয়াড়দের সার্টিফিকেট আছে। কিন্তু সেটা খেলোয়াড় সহ ম্যানেজারদেরও দেওয়া হতো। ওতে কি করে বোঝা যাবে প্রথম একাদশে কারা ছিল ? আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের সমস্যা কম, কিন্তু বহু মেয়ে যাঁরা দীর্ঘদিন রাজ্য দলে খেলেছেন তাঁদের কিছুই রেকর্ড নেই। আমরা নিজেরা চিহ্নিত করছি, চেষ্টা করছি স্কোরগুলো জোগাড় করার।
প্রশ্নঃ আপনার সহ খেলোয়াড় দের সম্পর্কে কিছু বলুন।
গার্গী : সেই সময় আমি, সন্ধ্যা আগরওয়াল, শুভাঙ্গি কুলকার্নী, শান্তা রঙ্গস্বামী, ডায়না এডুলজি, মিঠু মুখার্জী আরও অনেকে অনেক পারফরম্যান্স দেখিয়েছি। আমার ৭৫ বা ৬ উইকেট, ডায়নার বোলিং, সন্ধ্যার ১৯০ , শান্তা প্রথম ভারতের হয়ে টেস্টে সেঞ্চুরি করলো..... আমরা যদি এইভাবে কোনো চাহিদা ছাড়া না খেলতাম তাহলে মহিলা ক্রিকেট ভারতে এই জায়গায় আসতো না। আমরা শুধু ক্রিকেট নিয়ে ভাবতাম। নিজেদের নিয়ে নয়। এখনকার লোকজন আমাদের সেইভাবে চেনে না। ইতিহাসটাই জানে না। আমরা আজকের ক্রিকেটারদের নাম, রেকর্ড কিন্তু মনে রাখি, কিন্তু আজকের মহিলা ক্রিকেটাররা আমাদের কথা বলে না। এটা খুবই দুঃখের। আমরা যদি না থাকতাম ওরা কোথায় আসতো ?
প্রশ্নঃ আগামী দিনে ভারত আর বাংলার ভবিষ্যত কারা ?
গার্গী : ভারতের বললে জেমিমা রডরিগেজ আর শেফালী ভার্মা। জেমিমা নাম্বার ওয়ান। ও প্রডিজি।
বাংলার অনেক সম্ভাবনা আছে, ধারাবাহিকতা দেখাতে পারলে অনেক দূর যাবে। মঞ্জিরা মহাপাত্র আর পারমিতা রায়। ওরা ভালো খেললে ওরাই আমাদের ভবিষ্যৎ।