অধিনায়কত্ব অতীত; কেরিয়ারের বাকি সময় ফোকাস শুধু ব্যাটিং-এ
ময়ূখ লাহিড়ী
বছর বারো আগের কথা। আইপিএলের দ্বিতীয় মরশুম। কলকাতা নাইট রাইডার্সের কোচ হিসাবে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন জন বুকানন। নেপথ্যে অজি কোচের ‘মাল্টিপল ক্যাপ্টেন’ থিওরি। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে অবশ্য তা চালু হয়ে গিয়েছিল চলতি সহস্রাব্দের গোড়ার দিকেই। যখন স্টিভ ওয়ার হাত থেকে একদিনের ম্যাচের অধিনায়কত্ব কেড়ে তা দেওয়া হয়েছিল রিকি পন্টিং-এর হাতে।
২০২১-এর শেষ দিকে ভারতীয় ক্রিকেটও পৌঁছে গিয়েছিল অজি ক্রিকেটের সেই ‘মাল্টিপল ক্যাপ্টেন’ তত্ত্বের চৌকাঠে। কিন্তু শেষমেশ যে তা হল না তার পিছনে থাকল বিরাট কোহলির আচমকা নেওয়া সিদ্ধান্ত। গত টি-২০ বিশ্বকাপের আগেই জানিয়েছিলেন, ছাড়তে চলেছেন টি-২০ দলের নেতৃত্ব। চলতি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের একদিনের দল বাছার সময় নির্বাচকরাই তাঁকে ছেঁটে ফেলেছিলেন একদিনের দলের অধিনায়কের পদ থেকে। ছিল শুধু টেস্ট দলের অধিনায়কের ব্লেজার। শনিবার তাও তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন ভিকে।
কিন্তু কেন এমন সিদ্ধান্ত? নেহাতই আচমকা? শুধুমাত্র ‘ফাইনাল ফ্রন্টিয়ার’ হিসাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় টেস্ট সিরিজ না জিততে পারা? এগিয়ে গিয়েও সিরিজে হার হজম করা? নাকি অন্য কিছু? বোর্ড সভাপতি ও প্রধান কোচের ‘সাঁড়াশি আক্রমণ’-এর চাপ সহ্য করতে না পারা?
কিন্তু বিরাট কোহলি চাপ সহ্য করতে পারবেন না! যাবতীয় চাপকে তুড়ি মেরে নস্যাৎ করাই যিনি অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিলেন! বিপক্ষ তাদের সমস্ত অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপাবে, গোটা দুয়েক ইনিংসে পরিকল্পনামাফিক আউট করবে কোহলিকে, কিন্তু যাবতীয় হিসাব উল্টে দিয়ে তিনি ফিরে আসবেন। এটাই তো পরিচিত বিরাট কোহলি! তাঁর খারুশ মানসিকতা গোটা দলের মধ্যে আমদানি করতে যিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন, তিনি হঠাৎ করে কি করে হারিয়ে ফেললেন নিজের জনপ্রিয়তা? গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন কিছু নয়। সেই ভিজি-সি কে নাইডুর আমল থেকে শুরু। যা চরমে উঠেছিল কপিল-গাভাসকর জমানায়। তার জেরেই ১৯৮৩ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েও নেতৃত্ব খোয়াতে হয়েছিল হরিয়ানা হারিকেনকে। আর নেতৃত্ব ফিরে পেয়ে দলকে ১৯৮৫-এর বেনসন অ্যান্ড হেজেস ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন করে ভারতীয় ক্রিকেটে আর এক নতুন ইতিহাস লিখেছিলেন তৎকালীন ‘লিটল মাস্টার’। কিন্তু এতসবের পরেও ১৯৮৭-তে যথেষ্ট সম্মানজনকভাবে অবসর নিয়েছিলেন সানি। কপিল তারপরেও নিজেকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন আরও কয়েকবছর।
সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেননি কোহলি! যদি না-ই নেন তাহলে সদ্যসমাপ্ত টেস্ট সিরিজে কে এল রাহুল-সহ কার্যত গোটা দলকে নিয়ে আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেন কীভাবে! যদি না-ই নেন তাহলে ফর্মে ফেরার জন্য কেপটাউন টেস্টে স্বভাববিরুদ্ধভাবে ৭৯ রানের ওই দুর্দান্ত ইনিংস খেললেন কী করে! নিউল্যান্ডসে দ্বিতীয় ইনিংসে করেছেন মাত্র ২৯ রান। কিন্তু তার পিছনে কী অসম্ভব পরিশ্রম রয়েছে তা কোনও স্কোরবোর্ডে লেখা থাকবে না।
যা থেকে যাবে তা হল কিছু পরিসংখ্যান, ক্রিকেটগাথায় ঢুকে যাওয়া কিছু ইনিংস আর একরাশ বিতর্ক। অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডে দর্শকদের মধ্যমা দেখানো দিয়ে যার শুরু আর আম্পায়ারের দিকে তর্জনী তুলে যার শেষ; বিপক্ষকে টিপ্পনী-কাটা স্লেজিং দিয়ে যার শুরু আর শেষ বিপক্ষ শিবিরের দিকে কুৎসিত কাদা ছোঁড়াছুঁড়িতে।
তবে ভুল কোহলি করেছিলেন নিঃসন্দেহে। প্রথম এবং ধারাবাহিক ভুল হল, ব্যাটে রানের খরা সত্ত্বেও মিডিয়ায় গরমাগরম বিবৃতি দেওয়া। আর শেষ ভুল, নেতৃত্ব ছাড়া নিয়ে বোর্ড সভাপতির মন্তব্যকে প্রচারমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে খারিজ করে দেওয়া। সমালোচকরা বলবেন, শচীন যেমন যাবতীয় সমালোচনার জবাব দিতেন নিজের চওড়া উইলো দিয়ে, বিরাটও সেই পন্থা নিলে পারতেন। কিন্তু ব্যাটের লোগো এক হলেই তো আর দুটো মানুষ এক হয়ে যায় না। বিরাট এরকমই। বেপরোয়া। আগ্রাসী। খুনে মেজাজের। বিপক্ষকে কুপোকাত করার জন্য ব্যাট আর মুখ – দুই অস্ত্রই ব্যবহার করেন। আর সেটা করেই চোখধাঁধানো সাফল্য পেয়ে এসেছেন গত এক দশক ধরে। কিন্তু যেটা বুঝতে পারলেন না সেটা হল, ব্যাট না চললে মুখ চালানো যায় না।
অথবা, হয়তো দু’বছর ধরে শতরান না পাওয়ার যন্ত্রণার দাঁড়ি টানতে চাইছিলেন একটা মনে রাখার মতো ইনিংস খেলে। কারণ, কোহলি জানেন, ভারতের সফলতম টেস্ট অধিনায়ক (৬৮ টেস্টে দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ৪০ টিতে জয়) হয়ে ইতিহাস জাপটে টিকে থাকা তাঁর ধাতে সইবে না। তিনি আদ্যন্ত ব্যাটসম্যান। দৃঢ়চেতা। আক্রমণাত্মক। তাই ক্রিকেটজীবনের বাকি সময়টা তিনি বোধহয় শুধু ব্যাটিংটাই মন দিয়ে করতে চান। যে মঞ্চ তাঁকে প্রস্তুত করে দিয়েছে নিউল্যান্ডসের ৭৯।