বর্ডার-গাভাসকার টেস্ট সিরিজে ভারত ২ -অস্ট্রেলিয়া ১
অলিভিয়া ডায়াসটেস্ট ক্রিকেটের রোমাঞ্চ চাক্ষুস করে নিলেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। ধৈয্যের সঙ্গে সাহসিকতার মিশেল, সংযমের পাশে ঝুঁকির আনাগোনা, সবই যেন একসূত্রে বাঁধা হয়ে রইল ভারতের এই ঐতিহাসিক জয়ে। ইস্পাত কঠিন মানসিকতা এবং প্রত্যয় সঙ্গে থাকলে যে অনভিজ্ঞতা বিশেষ বাধা সৃষ্টি করতে পারে না, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন শুভমন গিল, মহম্মদ সিরাজ, ঋষভ পন্থরা।
মনে ছিল একঝাঁক প্রশ্ন। শেষ দিন কি জয়ের জন্য ঝাঁপাবে টিম ইন্ডিয়া? না কি ড্রয়ের লড়াই চালিয়ে বর্ডার-গাভাসকর ট্রফি ‘মালিকানা’ ধরে রাখার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে মাঠে নামবে ভারত? দেশের জার্সিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ খেলতে নামা শুভমন গিলের ব্যাটিংয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল ভারতীয় ভক্তকুল। কিন্তু পূজারা? তাঁর ব্যাটিং দেখে তো বোঝার উপায় ছিল না, ঠিক কী ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট। যথারীতি মন্থর থেকে মন্থরতম ব্যাটিং। গিল ফেরার পর ওডিআই (টি-টোয়েন্টি বললেও ভুল হবে না) ভঙ্গিতে অধিনায়ক অজিঙ্কা রাহানের ছোট্ট ইনিংস।
ইনিংস ছোট হলেও, টেস্ট ক্রিকেটার হিসাবে খ্যাত অজিঙ্কের মারমুখী মেজাজ সমর্থকদের আশ্বস্ত করল- ড্র নয় জয়ের জন্যই ঝাঁপাচ্ছে দল। পূজারা কিন্তু তখনও হেলদোলহীন, ব্যাটিং করে চলেছেন আপন খেয়ালে। শুরুতে ঋষভ পন্থ সিডনি মার্কা ব্যাটিং করেননি। তাহলে কি দ্রুত উইকেট খুইয়ে ড্রয়ের রাস্তায় ফিরে গেল মেন ইন ব্লু!
ধীরে ধীরে এগোতে থাকল স্কোরবোর্ড। হাত খুলতে শুরু করলেন পন্থ। কিছুটা যেন স্বাভাবিক হলেন পূজারা। আউট হওয়ার আগে তাঁর নামের পাশে ৫৬। মোকাবিলা করেছেন ২১১ বলের। বলার অপেক্ষা রাখে না, খুবই মন্থর ইনিংস। কিন্তু খাটো করার উপায় আছে কি? এটাই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার তাগিদ। জুনিয়রদের কাঁধে হাত রেখে এক নিঃশব্দ বার্তা, ‘আমি তো আছি একদিকে, তোরা খেলে যা নিজেদের খেলা।’
মায়াঙ্ক নিয়ে কেউ হয়তো বিশেষ স্বপ্ন দেখেননি। তবুও আশায় বাঁচে চাষা। ভারতীয় ‘ক্রিকেটচাষী’রা মনে তখন হাজারো আশার আলো। আইপিএলে ভাল খেলেছিলেন, সেঞ্চুরিও করেছিলেন, দল থেকে বাদ পড়ার জবাব দেবেন, আরও কত কী! কিন্তু মায়াঙ্ক বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন, জাতীয় দলের দরজা তাঁর কাছে বন্ধের মুখে। ওয়াশিংটন সুন্দরকে নিয়ে লড়াই চালালেন পন্থ। তখন দুই তরুণ একেবারে টপ গিয়ারে। গাব্বার মাঠে বিশ্বের এক নম্বর পেসার প্যাট কামিন্সকে অনায়াস ভঙ্গিমায় পুল করে ছক্কা হাঁকাচ্ছেন ভারতের এক তরুণ তুর্কি। যে কি না কেরিয়ারের প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নেমেছেন। বয়স মাত্র ২১। ব্যাটিং পজিশন সাত। দল প্রবল চাপে। ভাবা যায়! পরের ওভারে শততম টেস্ট খেলতে নামা নাথান লিয়নে এক ওভারে তিনটি চার। যার মধ্যে দুটি পন্থের উইলো থেকে, অপরটি বাই। ব্যাস, ম্যাচ এখানেই চলে আসে ভারতের হাতের মুঠোয়। তবুও তাজা রক্ত আর উটকো তাড়া, ভুল তো হবেই। পরপর ফিরলেন সুন্দর এবং শার্দুল। তাতে কি কিছু যায় আসে? ৩৬ ইঞ্চি ছাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন হ্যাজেলউডের সামনে। ওভারের শেষ বল ঠেলে দিলেন লং অফে। জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল তখনও তিন রান। প্রথম রান নেওয়ার পরেই সেলিব্রেশন। বল গড়াতে হড়াতে বাউন্ডারি লাইন ছুঁয়ে ফেলেছে। বল বাইরে যেতেই মাঠের ভেতরে ভারতীয় ক্রিকেটারদের দৌড়। সিরাজ-পৃথ্বীদের বাধভাঙা উচ্ছ্বাসের ঢেউ স্বাভাবিকভাবেই সুনামির মতো আছড়ে পড়ল পন্থের উপর।
অজিঙ্কা রাহানের এই দলটিকে ভারতের ‘বি’ টিম বললে কি খুব ভুল বলা হবে? কারও এটাই প্রথম ম্যাচ, কারও আবার দ্বিতীয় বা তৃতীয়। কারও বয়স ২১ তো কারও আবার ২২ কী ২৩। উল্টোদিকে বিশ্বের এক নম্বর দল, অস্ট্রেলিয়া। তাও আবার নিজেদের দেশের মাটিতে। শক্তি বিচারে পূর্ণ। ভারতীয় ক্রিকেট হয়তো এই লড়াই, এই জয় কোনও ভুলতে পারবে না। সিংহের ডেরায় গিয়ে সিংহ শিকার, তাও আবার ‘শিক্ষানবিশ’ শিকারি।
সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই ক্রিকেট।
ছবি- টুইটার