ভারতীয় ক্রিকেটের নতুন যুগের দিশারী হয়ে উঠছেন একঝাঁক প্রান্তিক খেলোয়াড়
ময়ূখ লাহিড়ীরূপকথা! আর কী-ই বা বলা যায়! সিরিজের প্রথম টেস্টে ৩৬ অল আউটের ভূত। দ্বিতীয় টেস্ট থেকে বিরাট কোহলি এবং মহম্মদ শামি নেই। তা সত্বেও অ্যাডিলেডে আট উইকেটে হারের বদলা নিয়ে মেলবোর্নে আট উইকেটে জয়। সিডনিতে কার্যত হাসপাতাল হয়ে যাওয়া দল নিয়ে বুক চিতিয়ে ম্যাচ বাঁচানো। আর ব্রিসবেনে জসপ্রীত বুমরা, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, উমেশ যাদব, হনুমা বিহারী-হীন দলের মহাকাব্যিক জয়। তাও এক দিনে ৩২৮ রানের আপাত অসম্ভব লক্ষ্য তাড়া করে। সঙ্গে টানা দু’বার সিরিজ জয় স্যার ডনের দেশ থেকে।
আসলে ঠিকই বলেছেন শচীন তেন্ডুলকর। এই সিরিজে প্রতি সেশনেই এক-একজন করে নতুন নায়ক খুঁজে পেয়েছে টিম ইন্ডিয়া। গাব্বাতেই যেমন। প্রথম দিনে অজিদের পাঁচ উইকেটের বেশি ফেলতে পারেনি ভারত। পাঁচজন বোলার নিয়ে নামলেও নবদীপ সাইনির চোট কার্যত বোলারের সংখ্যা চারে নামিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকেই দলকে ম্যাচে ফিরিয়েছিলেন নটরাজন, শার্দুল ঠাকুর, ওয়াশিংটন সুন্দররা। তৃতী দিন যখন ফের দল ধুঁকছে তখন ব্যাট হাতে শার্দুল-সুন্দরের অনবদ্য ১২৩ রানের জুটি। সিরাজ যদি পাঁচ উইকেট নিয়ে চতুর্থ দিনের নায়ক হন তাহলে তার পাশাপাশি শার্দুলের চার উইকেটও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর শেষ দিন অজি বোলিং-এর ঝাঁঝ সামলে দলকে অবিস্মরণীয় জয় এনে দিলেন শুভমান গিল, ঋষভ পন্থ এবং অবশ্যই চেতেশ্বর পুজারা। এই তালিকায় পুজারার নাম দেখে হয়তো চোখ কপালে তুলবেন অনেকেই। কিন্তু শরীর লক্ষ্য করে অবিরাম শর্ট বল, কার্যত বডিলাইন বোলিং-এর যে নমুনা প্যাট কামিন্সরা রাখলেন আর যেভাবে বারংবার আঘাত পেয়েও দেবু মিত্রের ছাত্র ২১১ বলে ৫৬ রানের স্থিতধী ইনিংস খেলে গেলেন তা এককথায় অসাধারণ।
অথচ ধারে-ভারে কয়েক যোজন এগিয়ে ছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু সেই আদিম কাল থেকেই তো বারবার গোলিয়াথদের হারিয়ে এসেছে ডেভিডরা। তাও আগের দিনের বৃষ্টিভেজা পিচের ফায়দা সেভাবে তুলতেই পারেননি মিচেল স্টার্ক, জশ হ্যাজলউডরা। উল্টে, মন্থর হয়ে যাওয়া আউটফিল্ডে বারবার বল ঠেলে অজি ক্রিকেটারদের পরিশ্রান্ত করে দিলেন শুভমান, ঋষভরা। শেষ ঘণ্টার খেলা যখন উত্তেজনার তুঙ্গে তখন শর্ট বল করে খেলা ড্র করার একটা চেষ্টা করছিল অস্ট্রেলিয়া। সেই অস্ট্রেলিয়া। যারা কয়েক বছর আগে এমন পরিস্থতিতিতে রিকি পন্টিং-এর জমানায় দাঁত-নখ বের করে বিপক্ষকে ছিঁড়ে ফেলতে নামত। কিন্তু এই অস্ট্রেলিয়া অনেক স্তিমিত। তা সে যতই দলে স্টিভ স্মিথ, মার্নাস লাবুশেন, ডেভিড ওয়ার্নাররা থাকুন না কেন। শেষ সাত ওভারে যখন ৩৯ রান প্রয়োজন তখনই গোটা দলের কাঁধ ঝুলে গিয়েছে। উইকেট তোলা নয়, তখন বাউন্ডারিতে ফিল্ডার ছড়িয়ে দিয়ে রান আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন টিম পেইন। ফ্লাই স্লিপ, ডিপ স্কোয়্যার লেগ, কাউ কর্নার, সুইপার কভারে রক্ষী মোতায়েন। কিন্তু যাবতীয় স্ট্র্যাটেজি ভোঁতা করে দিয়ে পরের তিন ওভারে ২৯ রান তুলে নিলেন ঋষভরা। তারপর অল্প ব্যবধানে ওয়াশিংটন সুন্দর এবং শার্দুল ফিরে গেলেও পাল্টা চাপ তৈরি করে ম্যাচ বের করতে পারেনি অজিরা।
কিন্তু কারা করলেন এই অসম্ভবকে সম্ভব? একদল এমন ক্রিকেটার যাঁরা কোনওভাবেই সমাজের তথাকথিত ‘উঁচুতলার বাসিন্দা’ নন। টি নটরাজনই যেমন। গাব্বায় টেস্ট অভিষেকে গুরুত্বপূর্ণ তিন উইকেট তুলে নিয়েছেন। কিন্তু কোন পরিবার থেকে উঠে এসেছেন নটরাজন? বাবা ছিলেন স্টেশনের মালবাহক। আর মা করতেন দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে। কিন্তু যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা সত্বেও ছেলেকে ক্রিকেটার হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন থেকে সরে আসেননি। বাকি রাস্তাটা গড়ে নিয়েছেন নটরাজন নিজেই। স্রেফ নিজের পারফরম্যান্সকে সম্বল করে।
গাব্বার দ্বিতীয় ইনিংসে পাঁচ উইকেট তুলে যিনি দলকে জয়ের রাস্তা দেখিয়েছেন সেই মহম্মদ সিরাজই যেমন। বছর কয়েক আগেও হায়দরাবাদের রাস্তায় অটো চালাতেন সিরাজের বাবা। তবু তার মধ্যেই স্বপ্ন দেখতেন, ছেলে নামজাদা ক্রিকেটার হবে। সিরাজ অস্ট্রেলিয়ায় থাকাকালীনই মৃত্যু হয় তাঁর বাবার। আর সেই বাবাকে মনে রেখেই ব্রিসবেনে উজাড় করে দিয়েছিলেন নিজেকে। তারই ফলশ্রুতি ৭৩ রানে পাঁচ উইকেট।
কুঁচকির মারাত্মক যন্ত্রণা সহ্য করে যিনি মাঠে নামলেন সেই নবদীপ সাইনিই যেমন। হরিয়ানার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছেন। দাদু ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের ট্রাকচালক। সেই লড়াকু মানসিকতারই উত্তরসূরি নবদীপ। হঠাৎই চোখে পড়ে গিয়েছিলেন গৌতম গম্ভীরের। গোতিই তাঁকে দিল্লিতে ট্রায়ালের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। নেট বোলার হিসাবে একসময় ডাক পেয়েছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। গোতি পরামর্শ দিয়েছিলেন, রঞ্জি খেলে পারফর্ম করতে পারলে নেট বোলার নয়, দলের পূর্ণসদস্য হিসাবেই বিদেশ সফরের সুযোগ মিলবে। সেই কথা সত্যি করেই অস্ট্রেলিয়া সফরের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে দেখা দিয়েছেন সাইনি।
ব্রিসবেন টেস্টে অলরাউন্ড দক্ষতার জেরে যিনি বিশেষজ্ঞদের নজর কেড়েছেন সেই শার্দুল ঠাকুরকেও কম ঝক্কি পোয়াতে হয়নি। মহারাষ্ট্রের মফস্বল শহর পলঘরে থাকতেন। যেখানে সেভাবে অনুশীলনের সুযোগই ছিল না। ছেলের ক্রিকেট অনুশীলনের জন্যই মুম্বইয়ের উপকণ্ঠে বইসারে চলে আসেন তাঁর বাবা-মা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পরেই চূড়ান্ত বিদ্রুপের শিকার হয়েছিলেন ১০ নম্বর জার্সি পরে। তার জেরেই জার্সি নম্বর বদলে ৫৪ করে নেন। টেস্ট অভিষেকেও কুঁচকির চোটের জেরে ১০ বলের বেশি করতে পারেননি। কিন্তু টেস্ট আঙিনায় ফিরেই দেখিয়ে দিলেন, বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা, শার্দুল ছুঁলে চুয়ান্ন।
তবে সফরের অন্যতম আবিষ্কার হিসাবে দেখা দিয়েছেন শুভমান গিল। পাঞ্জাবের প্রত্যন্ত গ্রামের সম্ভ্রান্ত কৃষক পরিবারে মানুষ। কিন্তু ছেলের ক্রিকেট কেরিয়ার গড়ার জন্য শুভমানের বাবা দীর্ঘদিন পড়ে থেকেছেন মোহালিতে। তারপর? স্রেফ পারফরম্যান্সের জোরে জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছেন। মেলবোর্নের ৪৫ এবং অপরাজিত ৩৫, ব্রিসবেনের ৯১ রানের ইনিংসে বুঝিয়ে দিয়েছেন, জাতীয় দলের জার্সি ফ্লুকে পাননি।
জানুয়ারি মাস মানেই ভারতীয়দের মনে আলাদা আবেগ কাজ করে স্বামী বিবেকানন্দ এবং নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে নিয়ে। যাঁরা দু’জনেই বলেছিলেন, প্রান্তিক মানুষদের সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতির মূলস্রোতে নিয়ে আসতে পারলে তবেই গড়া যাবে প্রকৃত ভারতবর্ষ। শার্দুল, শুভমান, সাইনি, নটরাজনরা সেই কথাকে সত্যি করতে পারেন কি না সেটাই এখন দেখার।