নেই বিকল্প পরিকল্পনা, হারের নেপথ্যে অতি-রক্ষণাত্মক মানসিকতা
সৈকত মুখোপাধ্যায়দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শেষ হলো বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল। দীর্ঘ টালবাহানার পরে ঐতিহাসিক লর্ডস থেকে খেলাটি সাউদাম্পটনের হ্যাম্পশায়ার বোল স্টেডিয়ামে স্থানান্তরিত হয়েছিল, কারণ লন্ডনে কোভিডের অতিরিক্ত প্রকোপ। সেই আঁচ যাতে ক্রিকেটারদের গায়ে না লাগে, তাই অপেক্ষাকৃত কম জনঘনত্বপূর্ণ এলাকায় ম্যাচটি স্থানান্তরিত করা হয় ইসিবি ও আইসিসি-র পক্ষ থেকে। জুন-জুলাই মাসে ইংল্যান্ডের যে কোনও প্রান্তেই অনবরত বৃষ্টির সম্ভাবনার কথা জেনেও আইসিসি-র এই সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিসঙ্গত তা হয়তো আইসিসি-র এক্সিকিউটিভ প্যানেলে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা ছাড়া কেউ জানেন না। ঐতিহাসিক কারণে লর্ডসকে মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু যখন লর্ডসে ফাইনাল আয়োজন করতে সাহস পেল না ইসিবি তখন সেটা কেন অস্ট্রেলিয়া বা সংযুক্ত আরব আমিরশাহী বা অন্য কোনও দেশে সরানো হল না, এই প্রশ্ন বিশ্বজুড়ে সমস্ত ক্রিকেটপ্রেমীর মনে উঁকি দিচ্ছে। কিন্ত উত্তর এখনও অজানা। এত গুরুত্বপূর্ণ খেলার প্রায় আড়াই দিন খেলা বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেল। রিজার্ভ ডে টেস্টে কেন রাখা হল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। প্রত্যেক বড় টুর্নামেন্টের আগে আইসিসি-র এরকম অদ্ভুত নিয়ম ও সিদ্ধান্ত ক্রিকেটমনস্ক মানুষদের খুবই ভাবাচ্ছে। ২০১৯-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে বাউন্ডারির নিরিখে জয়ী দল ঘোষণা করা যেমন পৃথিবীর সমস্ত প্রান্তে সমালোচিত হয়েছে, ঠিক তেমনই বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও এমন একটা ফাইনাল সাউদাম্পটনের মতো জায়গায় কেন হবে তাই নিয়েও আইসিসি-র জবাব দিতে দায়বদ্ধ থাকা উচিৎ।
তবে সাড়ে তিন দিনের খেলায় যোগ্য দল হিসেবে ভারতকে প্রায় সমস্ত বিভাগে পিছনে ফেলে দিল নিউজিল্যান্ড। টেস্ট ক্রিকেটে জয় নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের উপর। যেমন দল নির্বাচন, স্ট্র্যাটেজি ও তার প্রয়োগ, প্ল্যান বি ও প্ল্যান সি, টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ম্যাচের প্রতি মনোভাব, বোলিং, ফিল্ডিং এবং সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অধিনায়কত্ব। প্রায় সব বিভাগেই নিউজিল্যান্ড অনেক এগিয়ে গেল এই ম্যাচে। প্রথমেই আসি দল নির্বাচনে। মেঘলা আবহাওয়ায় দু'জন স্পিনার খেলানোর যুক্তি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। জাদেজার পরিবর্তে একজন অতিরিক্ত জোরে বোলার খেলানো যেত। সেক্ষেত্রে মহম্মদ সিরাজ একটা ভালো বিকল্প হতে পারতেন। অস্ট্রেলিয়ায় যে শরীরী ভাষা নিয়ে বল করেছেন এবং সফল হয়েছেন, তারপর এত গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে এবং সুইং সহায়ক উইকেটে সিরাজকে বসানোর সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হল জানি না। সিরাজ থাকলে শামিকে সুইং-এ যোগ্য সঙ্গত দিতে পারতেন যেটা বুমরা বা ইশান্ত পারলেন না। ফিল্ড প্লেসমেন্ট অনুযায়ী বুমরা একেবারেই সাধারণ বোলিং করে গেলেন গোটা ম্যাচ জুড়ে। শুধু অ্যাঙ্গল তৈরি করে আর হঠাৎ একটা বল পা পেঁচিয়ে ছুঁড়ে মারলেই উইকেট আসে না এবং আসেওনি। এত বড় ম্যাচে ভারতের মূল স্ট্রাইক বোলার একটাও উইকেট তুলতে পারেননি। বলের গতি পরিবর্তন করেও চেষ্টা করেননি ব্যাটসম্যানকে বিব্রত করার। ইশান্ত শর্মা একশটি টেস্ট খেলার পরেও প্ল্যান করতে পারলেন না। চতুর্থ স্টাম্পের লাইনে বল ফেলে দু'দিকে মুভমেন্ট করানোটা আজও অধরাই থেকে গেল তাঁর। একমাত্র শামি প্রথম ইনিংসে উইকেট এবং আবহাওয়াকে কাজে লাগলেন। ঠিক এই জায়গায় সিরাজের অভাব স্পষ্টভাবে বোঝা গেল। ব্যাটসম্যানকে ফাঁদে ফেলার কোনও চেষ্টাই ভারতের বোলাররা করলেন না। আর ঠিক সেই ফায়দাটা পুরোপুরি তুললেন কেন উইলিয়ামসন। প্রথম ইনিংসে যেভাবে শিট অ্যাঙ্করের ভূমিকা পালন করলেন ও লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানদের নিয়ে খেললেন তা নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। দেখে মনে হচ্ছিল, ড্রেসিংরুম থেকে সেট হয়ে এসেছেন এবং একদম জানেন তাঁকে কি করতে হবে, প্ল্যান রেডি। শুধু ঠান্ডা মাথায় প্রয়োগ করে বেরিয়ে গেলেন। এছাড়াও, অনবদ্য অধিনায়কত্ব দেখলাম বহুদিন পর টেস্ট ক্রিকেটে। আন-অর্থোডক্স ফিল্ড প্লেসমেন্ট করলেন টেস্ট ক্রিকেটে, প্রতিটি ব্যাটসম্যানের জন্য আলাদা করে। ভুল করতে বাধ্য করলেন ঋষভ পন্থকে, অনবদ্য বোলিং পরিবর্তন, এবং কিউই বোলাররা যোগ্য সম্মান দিলেন অধিনায়ককে প্রতিনিয়ত ঠিক লাইনে বলে করে। যেন মনে হচ্ছিল কেন একটা নীল কাগজ নিয়ে মাঠে নেমেছেন যেখানে প্ল্যানটা পুরো আঁকা আছে। ওনার কাজ মিস্ত্রি কে দিয়ে সেই অনুযায়ী ইট গাঁথানো। করলেনও তাই। সঙ্গে নিজের অনবদ্য ব্যাটিং-এর শৌর্য দেখালেন গোটা বিশ্বকে, যে ব্যাট দিয়ে কিভাবে চাপ কমিয়ে সেটা বিপক্ষ অধিনায়কের মাথায় দিয়ে দিতে হয়। বরফের মতো মস্তিষ্ক নিয়ে প্রত্যেকটা কাজ এত সুন্দর করে সাজিয়ে করলেন যে কোনো প্রশংসাই তাঁর জন্য যথেষ্ট নয়। আর ঠিক এই জায়গাতেই পিছিয়ে গেলেন বিরাট কোহলি। তাঁর কাছে কোনও বিকল্প প্ল্যান ছিল বলে মনে হয়নি। রোহিত আর গিলের সুন্দর শুরুর পরে অযথা পুজারার অতি ডিফেন্সিভ খেলা বোলারকে অক্সিজেন দিল এবং কোহলিও স্ট্রাইক রোটেট করতে পারলেন না। সেখানে পুজারার উইকেট নিউজিল্যান্ডের দিকে ম্যাচটা ঘুরিয়ে দিল, বিরাট নিজের স্বাভাবিক খেলা না খেলে বেশি রক্ষণাত্মক খেলতে গিয়ে নিজের উইকেট দিলেন। যে বলগুলো ড্রাইভ করা যায়, বাউন্ডারি মারা যায়, সেগুলোকে অযথা ডাক করার কোনও অর্থ হয় না। পুজারা আর কোহলি সেগুলোই করলেন। সেখানেই কিউই বোলাররা আরো চেপে বসলেন। দ্বিতীয় ইনিংসেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল। একটু চালিয়ে খেললে লিড দুশোর উপরে নিয়ে যেতে পারত টিম ইন্ডিয়া। কিন্তু ওই একই মনোভাব ও ভয় "যদি আউট হয়ে যাই" ডোবালো ব্যাটিংকে। শুভমন গিল ভালো অপশন কিন্তু আরও পরিণত ব্যাটিং করতে হবে, লম্বা ইনিংস খেলতে হবে। রোহিত কেন নিজের স্বাভাবিক খেলা খেললেন না সেটাই বোঝা গেল না। ড্রেসিংরুমের নির্দেশ কি এতটাই প্রভাব ফেলছে যে ব্যাটসম্যানরা নিজেদের স্বাভাবিক খেলা খেলতে পারছেন না? আদৌ কি কোচের কোনো স্ট্রাটেজি আছে? নাকি বিদেশে টেস্ট জিততে হলে কোনও এক অলৌকিক কাণ্ডের জন্য অপেক্ষা করতে হবে যে ঋষভ পন্থ বা অশ্বিন এসে অতিমানবীয় কিছু করে ম্যাচ জেতাবেন। যতদিন টপ অর্ডার ও মিডল অর্ডার রান করতে পারবে না, মনোভাব বদলাতে পারবে না, ততদিন ভারত বিদেশে অলৌকিক টেস্ট জিতবে, স্টিভের অশ্বমেধের ঘোড়া হয়ে উঠতে পারবে না, বিদেশে জেতাটা যারা অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিল এবং অলৌকিক কিছু না হলে তারা হারবে না। তফাৎ টা এই জায়গায়। পুজারা যদি নিজের খেলার ধরন না বদলান তাহলে হয়তো আর একবছর পর আর দলে থাকবেন না। গাদা গাদা বল খেলে সেট হয়েও কুড়ির বেশি রান করতে না পারলে ভারতীয় টেস্ট দলের তিন নম্বর আপনি নন। ওটা রাহুল দ্রাবিড়ের জায়গা ছিল। তবে ভারতীয় ক্রিকেটের এই মুহূর্তে অন্যতম সেনসেশন ঋষভ। যে প্রতিভা আছে তার সঠিক প্রয়োগ করতে পারলে গাব্বার অধ্যায় বারবার ফিরবে ভারতীয় ক্রিকেটে। কিন্তু একা রোজ ম্যাচ জেতানো যায় না। এটা টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের বুঝতে হবে। বুক পেতে সবসময় গুলি খেতে ঋষভ আসবে না। কখনও রোহিত, কোহলি, পুজারাকেও সেঞ্চুরির মতো ইনিংস খেলে অশ্বিন, পন্থদের কাজটা সহজ করে দিতে হবে। তবে এখনও বিরাট ছাড়া এই দলের অধিনায়ক কেউ হতে পারেন না। তবে কোচকে অবিলম্বে না সরালে আইসিসি ট্রফি আসবে না। কারণ, অধিনায়কের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানো কোচ দিয়ে ফাইনাল জেতা যায় না। স্ট্র্যাটেজি তৈরি করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ রবি শাস্ত্রী। আর সেখানেই ভারত একের পর এক ম্যাচ হারছে।
সব বিভাগেই ভারত পিছিয়ে গিয়েছে এই ম্যাচে। তবুও এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ ফাইনাল কখনও একটা ম্যাচের হতে পারে না। দুই বছরের পারফরম্যান্স একটা ম্যাচ দিয়ে বিচার করা অর্থহীন। এটা একটা তিন ম্যাচের সিরিজ হওয়া উচিৎ যেখানে আমরা সঠিক বিজয়ী পাব। লড়াই হবে সমানে-সমানে। একদিনের একটা খারাপ সেশন দিয়ে একটা দলকে বিচার করে তাদের অতীতের সব পারফরম্যান্সকে ভুলে যাওয়া একেবারেই অনুচিত। ভারত ভালো দল, খুব ভালো ক্রিকেট খেলেছে শেষ কয়েক বছর। তবুও বলব ফাইনাল খেলার টেম্পারামেন্ট এই দলের ব্যাটসম্যানরা হারিয়ে ফেলছেন। হয়তো মনোবিদ দরকার বা এমন একজন কোচ যিনি এই অবস্থা থেকে দলকে টেনে বার করে ট্রফির মুখ দেখাতে পারবেন। এই হার থেকে শিক্ষা নিয়ে কি পরিবর্তন আসে ভারতীয় দলে তা দেখার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।