• +91 6291642485
  • 6291642485
Banner

খেলার বিভাগ > ক্রিকেট

যশপাল শর্মাঃ বিশ্বকাপের বিস্মৃত নায়ক

১৯৮৩-এর বিশ্বকাপ দলের সদস্যের আকস্মিক প্রয়াণে স্পোর্টিওয়ার্ল্ডের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

ময়ূখ লাহিড়ী ও সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়

২২ জুন, ১৯৮৩। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। ইংল্যান্ডের ছুঁড়ে দেওয়া ২১৪ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে গিয়ে দু’উইকেটে ৫০ রান কপিলের ভারতের। তিনি ক্রিজে এলেন এবং ৬১ রানের ইনিংস খেলে জয়ের ভিত গড়ে দিয়ে গেলেন। অথচ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর, অর্থাৎ যশপাল শর্মার বয়স তখন চার বছরও হয়নি। বিশ্বকাপের মঞ্চে যশপালের জাত চেনানো অবশ্য সেখানেই শুরু নয়। গ্রুপ লিগের ম্যাচে অপ্রতিরোধ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে চমকে দিয়েছিল ভারত। নেপথ্যে সেই যশপাল। অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, ম্যালকম মার্শাল, জোয়েল গার্নার-খচিত পেস আক্রমণের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন ৮৯ রানের ম্যাচজেতানো ইনিংস। সমালোচকরা বলেন, ওই জয়ই দলের আত্মবিশ্বাস অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচেও খেলেছিলেন ৪০ রানের ঝকঝকে ইনিংস। গোটা বিশ্বকাপে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছিল মোট ২৪০ রান। যার জেরে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, বিশ্বকাপের গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলিতে ধারাবাহিকভাবে রান করে দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে বড় ভূমিকা ছিল যশপালের। কিন্তু প্রত্যাশিত খ্যাতি তিনি পাননি।

খ্যাতি না পাওয়ার পিছনে বড় কারণ ছিল যশপালের পরিসংখ্যান। যে পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪২টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার পরেও ৮৮৩ রানের বেশি করতে পারেননি যশপাল। গড় ২৮.৪৮। যার মূল কারণ ছিল আক্রমণাত্মক স্ট্রোক খেলা। যে স্ট্রোক খেলতে গিয়ে বহুবার উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে এসেছেন তিনি। অবশ্য একইরকম ব্যাটিং গড় এবং একই দোষে দোষী হয়েও যশপালের থেকে অনেক বেশি সুযোগ পেয়েছেন কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত। এমনকী, ভারতীয় দলের অধিনায়কও হয়েছিলেন। ভাগ্যের পরিহাস ছাড়া আর কি-ই বা বলা যায়!

টেস্টের আঙিনায়ও যশপালের পারফরম্যান্স আহামরি কিছু নয়। ৩৭ টেস্টে ১৬০৬ রান। গড় ৩৩.৪৫। দু’টি শতরান এবং ন’টি অর্ধশতরান। তবে ইডেনের সঙ্গে মধুর সম্পর্ক ছিল যশপালের। ১৯৭৯-তে অস্ট্রেলিয়া টেস্টে অপরাজিত ৮৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন। পরের বছর পাকিস্তান টেস্টে ৬২ রানের যে ইনিংস খেলেছিলেন তা এখনও অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর মনে থেকে গিয়েছে।

জাতীয় দলের জার্সি গায়ে শেষ টেস্ট খেলেছিলে ১৯৮৩ সালে। আর শেষ একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ ১৯৮৫-তে। তারপরেই বাদ পড়েন খারাপ ফর্মের জন্য। কিন্তু দলে ফেরার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন পুরোদস্তুর। ফর্ম ফিরে পাওয়ার আশায় পাঞ্জাব ছেড়ে হরিয়ানা রঞ্জি দলে যোগ দিয়েছিলেন। সেখান থেকে রেলে। ৩৭ বছর বয়সেও ঘরোয়া ক্রিকেটে শতরান হাঁকিয়েছেন। কিন্তু সেটা ১৯৯১-৯২ মরশুম। ভারতীয় দলে তখন পরিবর্তনের হাওয়া। ব্যাটিং অর্ডারে যে জায়গায় যশপাল ব্যাট করতেন সেই জায়গায় তখন শচীন তেন্ডুলকার নামের এক বিস্ময় প্রতিভা।

স্কুল ক্রিকেটেই প্রথম নজর কাড়তে শুরু করেছিলে যশপাল। পাঞ্জাবের হয়ে খেলেছিলেন ২৬০ রানের ইনিংস। পরে জুনিয়র পর্যায়ের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় ভালো পারফরম্যান্সের জেরে পাঞ্জাব রঞ্জি দলে। পরপর দু'টি অর্ধশতরান করে নিজের জাত চেনাতে শুরু করেন। পরে দলীপ ট্রফি এবং ইরানি ট্রফিতেও তাঁর পারফরম্যান্স ছিল রীতিমতো চোখধাঁধানো। টেস্ট অভিষেকের আগেই প্রস্তুতি ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ১৩৫ রানের ইনিংস খেলে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন যশপাল।

২০০৩ সালে জাতীয় নির্বাচক হয়েছিলেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ছিল তাঁর মেয়াদ। কিন্তু ২০০৫ সালে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং গ্রেগ চ্যাপেলের দ্বৈরথে সরাসরি মহারাজের সমর্থনে বিবৃতি দিয়ে বসেন যশপাল। ভারতীয় ক্রিকেট রাজনীতিতে তখন কোণঠাসা সৌরভ। তার জেরেই যশপালকে খোয়াতে হয়েছিল জাতীয় নির্বাচকের পদ। তবে ২০০৮ সালে ফিরে এসেছিলেন সেই পদেই। ছিলেন ২০১১ সাল পর্যন্ত। যে সময় বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ধোনির ভারত। ফলে, ভারতের দুই বিশ্বকাপ জয়ের সঙ্গেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছেন যশপাল। 

সাতের দশকের শেষের দিকে এক ঘরোয়া ম্যাচে যশপালের ব্যাটিং দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন দিলীপ কুমার। বলিউডের 'ট্র্যাজেডি কিং' তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু রাজ সিং দুঙ্গারপুরকে বলেছিলেন যশপালের কথা। সেই সময়কার ভারতীয় ক্রিকেটে দুঙ্গারপুরই ছিলেন শেষ কথা। ফলে নিজের পারফরম্যান্স এবং দুঙ্গারপুরের সহায়তায় জাতীয় দলে জায়গা করে নিতে বেশি সময় লাগেনি যশপালের। পরবর্তী জীবনে একাধিকবার যশপাল বলেছেন, "ইউসুফ ভাই না থাকলে হয়তো আমার কেরিয়ারই তৈরি হত না।" যশপালের 'ইউসুফ ভাই' প্রয়াত হয়েছেন ৭ জুলাই। আর তার এক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর ইউসুফ ভাইয়ের কাছে চলে গেলেন যশপালও।

চলতি বছরেই মুক্তি পাওয়ার কথা ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয় নিয়ে তৈরি হওয়া ছবি ‘৮৩’-এর। যেখানে যশপালের ভূমিকায় রয়েছেন যতীন সার্না। কিন্তু পর্দার যশপালকে আর দেখে যেতে পারলেন না বাস্তবের যশপাল। মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। তাও মাত্র ৬৬ বছর বয়সে। ২০২১ সালের ১৩ জুলাই সত্যিই ‘অপয়া’ হয়ে থাকল। 

     

বিজ্ঞাপন

Goto Top