অতিরিক্ত আগ্রাসনই ডেকে আনছে বিপদ
ময়ূখ লাহিড়ীদেশে বাঘ, বিদেশে বিড়াল। মহেন্দ্র সিং ধোনির পূর্বসূরী সমস্ত ভারতীয় অধিনায়ককেই শুনতে হয়েছে এমন কথা। কিন্তু বুধবারের লিডসে যেভাবে ভারতীয় ব্যাটিং তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল তাতে বোঝা দায় যে এই দলই গত দু’বার অস্ট্রেলিয়া থেকে সিরিজ জিতে ফিরেছে। গত বছরের শেষে অ্যাডিলেডে ৩৬ অল আউট হয়েছিল টিম ইন্ডিয়া। তার আট মাস পরে ফের ব্যাটিং ভরাডুবি। এবার পুরো দলের অবদান সাকুল্যে ৭৮।
কি রয়েছে এমন হারাকিরির নেপথ্যে? বিশেষজ্ঞদের অনেকেই আঙুল তুলছেন চেতেশ্বর পুজারা এবং অজিঙ্ক রাহানের দিকে। রাহানে তবু লর্ডসে মান বাঁচানোর মতো ৬২ রানের ইনিংস খেলেছেন। কিন্তু পুজারার ব্যর্থতা চলছে বেশ কিছুদিন ধরেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় অহরহ ওঠে টিম ইন্ডিয়ার ব্যাটিং অর্ডারের তিন নম্বর এবং পাঁচ নম্বরকে বাদ দেওয়ার জোরালো দাবি। কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে সেই আঁচ এসে লাগে না অধিনায়ক বিরাট কোহলির গায়ে। সরকারের নীতির সমালোচনা করলেই যেমন সমালোচকের গায়ে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ বা ‘মাওবাদী’ তকমা সেঁটে দেওয়া হয় সেরকমই কোহলির সমালোচনা করলেই ধেয়ে আসে অবশ্যম্ভাবী মন্তব্য, “ক্রিকেটের কিস্যু বোঝে না।“
সেরকমই যাঁরা ক্রিকেট ‘কম বোঝেন’ তাঁদের মতো করে দেখে নেওয়া যাক তথাকথিত ‘কিং কোহলি’-র সাম্প্রতিক রেকর্ড। টেস্ট, একদিনের ম্যাচ এবং আন্তর্জাতিক টি-২০ মিলিয়ে গত ৫০ ইনিংসে তিন অঙ্কের মুখ দেখেননি কোহলি। এই সময়ে তাঁর সর্বোচ্চ রান অপরাজিত ৯৪। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে টি-২০ ম্যাচে হায়দরাবাদে। একদিনের ম্যাচে শেষ শতরান ঠিক দু’বছর আগে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। পোর্ট অফ স্পেনে। আর যে ফর্ম্যাটে ব্যাটসম্যানদের জন্য সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করে থাকে সেই টেস্ট ম্যাচে কোহলির শেষ শতরান এসেছিল ইডেনে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, দিন-রাতের টেস্টে। তারপর থেকে বুধবারের ইনিংস নিয়ে খেলেছেন ১৮টি ইনিংস। যেখানে তাঁর ব্যাটিং গড় মোটে ২৩! আর উপমহাদেশের বাইরে কোহলির শেষ শতরান ২০১৮-এর ডিসেম্বরে। যখন পার্থে ১২৩ রানের দুর্দান্ত ইনিং বেরিয়েছিল তাঁর ব্যাট থেকে। কিন্তু তারপর থেকে ৩২টি টেস্ট ইনিংসে বিদেশের মাটিতে শতরান নেই।
নিন্দুকেরা বলতেই পারেন, ফর্ম ক্ষণস্থায়ী, ব্যাটসম্যানের জাতই আসলে চিরস্থায়ী। তুলে ধরতে পারেন নেভিল কার্ডাসের সেই বিখ্যাত উক্তিও। সঙ্গে বলতেই পারেন, “যে কোনও দিন রানে ফিরবে বিরাট।“ কিন্তু সেই ‘যে কোনও দিন’-টা যে কবে আসবে সেটাই প্রশ্ন।
এখানেই শেষ নয়। বিস্তর অভিযোগ রয়েছে অধিনায়ক বিরাটকে নিয়েও। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের আমলে প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে টক্কর দেওয়া শুরু হয়েছিল। আর মাহির জমানায় এসেছিল বিপক্ষের মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার মানসিকতা। আর বিরাট আমদানি করেছেন বাছাই করা বিশেষণ প্রয়োগের সংস্কৃতি। পঞ্চাক্ষর মন্ত্রের মতো তাঁর ঠোঁটে লেগে থাকে পাঁচ অক্ষরের বহুল পরিচিত হিন্দি বিশেষণ। কখনও মধ্যমা দেখান জঙ্গি দর্শকদের। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে শূন্যে ঘুষি চালান তাঁর বোলাররা উইকেট তুললে। কিন্তু এতকিছু সেই অধিনায়ককেই মানায় যাঁর ব্যাটে রান আছে। যিনি খুনে মেজাজে বিপক্ষকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারেন। আর এখানেই সমস্যা। অঙ্গভঙ্গি না করেও যে আগ্রাসন দেখানো যায়, খুনে মেজাজে থাকা যায় সেসব কোহলি বিশ্বাসই করেন না। তাই মাঠে মারাত্মক আগ্রাসী শরীরী ভাষা দেখানোর পরেও হাস্যাস্পদ হয়ে উঠছেন কোহলি। কারণ, ব্যাট-প্যাডের মাঝখানে যে ফাঁক রয়ে যাচ্ছে সেই ফাঁক দিয়েই পালিয়ে যাচ্ছে সব রান। শরীর থেকে দূরের বলে ড্রাইভ করা একরকম অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছেন। যার জেরে জিমি অ্যান্ডারসন কোহলিকে প্রিয় খাদ্যে পরিণত করে ফেলেছেন। অ্যান্ডারসন আউটসুইঙ্গার ছাড়বেন। কোহলি ড্রাইভ করবেন। এবং অচিরেই উইকেটরক্ষকের গ্লাভসে বা স্লিপের হাতে জমা পড়বেন। এটাই একরকম নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বুধবারই যেমন হল। ক্রিকেটের যে কোনও ব্যাকরণ বইতে লেখা থাকে, বলের অমসৃণ দিক বাইরের দিকে রেখে ২০ ডিগ্রি কোণে সিম ধরে বল ছাড়লে বল আউটসুইং করে। বুধবার টানা সেটাই করে যাচ্ছিলেন অ্যান্ডারসন। আর সেই ফাঁদেই পা দিয়ে আউট হয়েছিলেন কে এল রাহুল (০) ও পুজারা (১)। কোহলি প্যাভিলিয়নে বসেই সব দেখলেন। মাঠে নামলেন। সাত রান করে অ্যান্ডারসনের মার্কামারা আউটসুইঙ্গারে ড্রাইভ করতে গিয়ে ফিরলেন। ব্যাট আর প্যাডের মাঝখানে তখন ফুটখানেকের ফাঁক।
বুধবার তাজা পিচে কি কারণে কোহলি আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলেন সেটাও এক রহস্য। নিজেরা নাকানিচোবানি খেলেন ইংল্যান্ডের পেস ব্রিগেড্রর সামনে। আর বিকেলে যখন রোরি বার্নস, হাসিব হামিদরা ব্যাট করছেন তখন পিচ থেকে সামান্য সুইং আদায় করতে ঘাম ছুটছে শামি-বুমরাদের। পিচে ঘাস থাকলেই বল নড়ে, নাহলে নয় – এমন আশ্চর্য ধারণা কেন ভারত অধিনায়কের মাথায় ঢুকল সেটাই এই মূহুর্তে মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন।