৫০ বছর পরে ওভালে টেস্ট জয় ভারতের। ক্রিকেট গবেষত সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশেষ প্রতিবেদন
সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়রেঙ্গুনের বন্দীদশায় থাকাকালীন শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে একজন উর্দু জানা ব্রিটিশ অফিসার বলেছিলেন ‘‘দমদমে মে দম নহি হ্যায়/খ্যায়র মাঙ্গো জাঁ কে/ বস জাফর/ বড় চুকি ওর চল তৈয়র হিন্দুস্তান কি’’ অর্থাৎ ‘‘তোমার কামানে আর শক্তি নেই/ হে জাফর, ভারতের সূর্য অস্তমিত।’’
হেডিংলে টেস্টে ৭৮ ও ২৭৮ রান করে ইনিংসে হারার পর যখন ওভাল টেস্টে ১২৭/৭ হয়ে গেছে তখন এ কথাটাই মনে পড়েছিল। ভারতের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কোহলির ৫০ ছাড়া সবাই ব্যর্থ। তখন পালঘাটের মারাঠি ছেলে শার্দূল ঠাকুর পাল্টা যুদ্ধটা পৌঁছে দেন ব্রিটিশদের দোরে। ঠিক ৫০ বছর আগে যেভাবে সোলকার আর ইঞ্জিনিয়ার দিয়েছিলেন। গাভাসকার, অশোক মানকড়, দিলীপ সরদেশাই, অজিত ওয়াদেকার এর মতো তৎকালীন বোম্বের প্রধান চার ব্যাটসম্যান ও গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথকে হারিয়ে ভারত যখন ১২৫/৫ তখন সোলকার ও ইঞ্জিনিয়ার ৯৭ রান যোগ করে দলকে ২২২-এ পৌঁছে দেন। ফলে ভারত শেষ পর্যন্ত ২৮৪ তুলে ৭১ রানে পিছিয়ে ছিল।
এবারেও শার্দূলের লড়াই (৩৬ বলে ৫৭) ১৯১ অবধি টেনে নিয়ে যায়। এরপর দিনের শেষে ইংল্যান্ড ৫৩/৩। দ্বিতীয় দিনের শুরুতে অল্প সময়ের মধ্যে ৬২/৫। সেখান থেকে ২৯০ অবধি দল টেনে নিয়ে যায়। ওলি পোপ, জনি বেয়ারস্টো, মইন আলি আর ওকস মিলে সেই কাজটাই করলেন যেটা ৫০ বছর আগে নট, হাটন আর আন্ডারউড করেছিলেন। ফল ইংল্যান্ড ৯৯ রানে এগিয়ে।
এবার ভারতের প্রথম চার ব্যাটসম্যান রুখে দাঁড়ালেন। রোহিতের অষ্টম শতরান (১২৭), রাহুলের ৪৬, পূজারার ৬১ আর অধিনায়ক কোহলির ৫০ দলকে ২৯৬/৪ অবধি টানলেও একটু পরেই ৩১২/৬ হয়ে যায়। আবার দাঁড়িয়ে যান শার্দূল (৬০), পন্থ (৫০) ও দুই বোলার বুমরাহ (২৪) ও উমেশ যাদব (২৫)। ভারত ৪৬৬ তোলে।
চতুর্থ দিনের বাকি সময়ে ইংল্যান্ডের রান ৭৭/০(৩২ওভারে)। পঞ্চম দিন লাঞ্চে ১৩১/২(৫৯ ওভারে)। সেট হয়ে যাওয়া হামিদ (প্রায় ২০০-র কাছাকাছি বল খেলে ৫০ হয়ে গেছে) ও রুট দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু লাঞ্চের পরেই ধাক্কা। হামিদকে প্রথমে রবীন্দ্র জাদেজা ফেরালেন। তারপর পোপ আর বেয়ারস্টোকে বুমরাহ, তারপরেই মইনকে জাদেজা। ইংল্যান্ড ৪০.৩ ওভারে ১০০/০ থেকে ৬৭.২ ওভারে ১৪৭/৬। মানে শেষ ২৬.৫ ওভারে ৪৭/৬। এরপর রুট ফর্মের জন্যই রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তাকে উৎপাটিত করলেন বদলি আসা শার্দূল। ১৮২/৭। চা পানের বিরতির ঠিক আগে ৮৪.১ ওভারে ১৯৩/৮। অর্থাৎ এই সেশনে ২৫.১ ওভারে ৬২ রান তুলতে ৬ উইকেট পড়ে যায়। টা পানের বিরতির পরে ৪৫ মিনিটের ভেতর ইংল্যান্ড ২১০ রানে শেষ। উমেশ তিনটে উইকেট, জাদেজা ২টো, বুমরাহ ২টো, শার্দূল ২টো, একটা রান আউট।
৫০ বছর পরে ওভালে জয়। ৩৫ বছর পর এক সিরিজে দুটো টেস্টে জয় বিলেতের মাটিতে।
এবার দুটো টেস্টে জয়ই লন্ডনে।
বাহাদুর শাহ সেই ব্রিটিশ সমর্থককে বলেছিলেন ‘‘গাজিও মে হ্যায় বাকি যবতক লহু ইমান কি / তখত-এ-লন্ডন তক চলেগি তেঘ হিন্দুস্তান কি।’’ গাজি অর্থাৎ ধর্মযোদ্ধাগণের (তিনি ভারতের সঙ্গে ইংল্যান্ডের লড়াইকে ধর্মযুদ্ধ বলে মানতেন)শরীরে একবিন্দু রক্ত থাকলেও, ভারতের তরবারি লন্ডনের বক্ষ বিদীর্ণ করার জন্য উঁচিয়ে থাকবে।’’
এই ক্রমাগত মরে আসা পিচে (প্রথম দিন- ২৪৪/১৩, দ্বিতীয় দিন ২৯০/৭, তৃতীয় দিন ২২৭/৩, চতুর্থ দিন ২৭৩/৭) ভারতের ঘুরে দাঁড়ানো ও শেষ ৫২ ওভারে ইংল্যান্ডের ১০ উইকেট ১১০ রানের মধ্যে ফেলে দেওয়া যেন ১৬০ বছরের বিস্মৃতি থেকে তুলে আনলো শেষ মুঘল সম্রাটকে। সাগর পাড়ে ব্রিটিশদের খেলা ক্রিকেটে ভারত ব্রিটিশদের দুবার একই সিরিজে লন্ডনে হারালো। তাও আবার টেস্টে! দেখা যাক পঞ্চম টেস্টে কি হয়!