বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তির রোডেশিয়া সফর
সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়১৯৭১। সালটা মনে পড়লেই যে কোনও ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীর মধ্যে নতুন করে অ্যাড্রিনালিন ঝরতে থাকে। সেই বছরের ক্যারিবিয়ান সফরেই অভিষেক হয়েছিল বছর একুশের এক তরুণের। পরবর্তী ১৬বছর যিনি বিশ্বক্রিকেটকে শাসন করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে একসময় বিশ বাঁও জলে ছিল সেই সিরিজ। নেপথ্যে ছিল স্যার গারফিল্ড সোবার্সের বিতর্কিত রোডেশিয়া সফর। ৪৮ ঘন্টারও কম সময় রোডেশিয়ায় কাটিয়েছিলেন সোবার্স । কিন্তু সেই ঘটনা এমন রাজনৈতিক ঝড় তুলেছিল যে পাল্টে যেতে বসেছিল ক্রিকেটের ইতিহাস। জড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত। কি ঘটেছিল ?
‘দ্য স্টপ সেভেন্টি ট্যুর’ সফল হওয়ার ফলে দক্ষিণ আফ্রিকার ইংল্যান্ড সফর বাতিল হয় ও দক্ষিণ আফ্রিকা টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। তার বদলে বিশ্ব একাদশ ইংল্যান্ড সফরে গিয়ে পাঁচটি টেস্ট খেলে, যা প্রথমে টেস্ট বলে মর্যাদা পেলেও পরে তা কেড়ে নেওয়া হয়। ওই সফরের শেষে এডি বার্লো সোবার্স কে রোডেশিয়ায় (বর্তমান জিম্বাবোয়ে) ডবল উইকেট টুর্নামেন্ট খেলতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। সোবার্স দেশটিতে ‘বর্ণবৈষম্য’ চলছে কিনা জেনে নিয়ে রাজি হয়ে যান (যদিও এটা তিনি তাঁর আত্মজীবনী গ্রন্থে বলেছেন, সেই সময় নয়)।
সেখানে আলি বাখারের সঙ্গে জুটি বেঁধে খেলেন। কিন্তু বিমান থেকে নামার পর বিশ্রাম পেয়েছিলেন মাত্র দু’ঘন্টা। ফলে জিততে পারেননি। যদিও বিপুল সংবর্ধনা পেয়েছিলেন। সঙ্গে ৬০০ পাউন্ড পারিশ্রমিকও। রোডেসিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইয়ান স্মিথের তিনি প্রশংসা করেন এবং ইয়ান স্মিথ ও তাঁর প্রশংসা করেন। তিনি এও বলেন যে দক্ষিণ আফ্রিকার খেলোয়াড় রা বিশ্বমানের। তাঁরা জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে খেলতে চান। ওয়েস্ট ইন্ডিজে যদি বিশ্ব একাদশ খেলতে আসে তাহলে ভালোই হবে।
এদিকে, ১৯৭০ সালের ৭ ই সেপ্টেম্বর লন্ডনের একটি খবরের কাগজ এই খবর প্রকাশ করার পর থেকেই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। ১২ সেপ্টেমর প্রাক্তন প্রথম শ্রেণির আম্পায়ার ও বার্বাডোজ ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ফ্র্যাঙ্ক ওয়ালকট বিবৃতি দেন, যেখানে ক্যারিবিয়ানদের চরিত্র ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় সেখানে যাওয়া উচিত নয়। তিনি সোবার্স কে অধিনায়ক পদ সরিয়ে দেওয়ারও দাবি করেন ভার্জিন আইল্যান্ড থেকে প্রকাশিত একটি সংবাদপত্রে।
মাইকেল ম্যানলি (রাজনৈতিক নেতা ও ক্রিকেট লেখক) পরিষ্কার বলে দেন ক্ষমা না চাইলে কোথাও যেন সোবার্স কে অভ্যর্থনা না করা হয়। যে কোনো খেলার থেকে ক্যারিবিয়ান জনগণের ন্যায় অনেক বেশি কাম্য।
অ্যান্টিগা লেবার পার্টির মুখপত্ৰ ‘ওয়ার্কার্স ভয়েস’ সোবার্সকে ‘আ হোয়াইট ইন ব্ল্যাক ম্যান’ তকমা পর্যন্ত দিয়ে বসে। ‘দ্য এজ’ দাবি করে, দুনিয়ার সর্বত্র আফ্রিকান ও বিশেষ করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের লোকেদের আনুগত্য সোবার্স হারিয়েছেন।
স্বাধীনচেতা সোবার্স এর কোনও কিছুকেই বিশেষ আমল দেননি। উল্টে দাবি করেন, তিনি এভাবে কিছু ভেবে দেখেননি। ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলেন পেশাদার ক্রিকেটার হিসেবে। রাজনীতিবিদ হিসেবে যাননি। রোডেশিয়ার কোথায় কি হচ্ছে তা তিনি জানতে চান না।
বিষয় জটিল হলো যখন গায়ানার প্রধানমন্ত্রী ফোর্বস ব্রুনহ্যাম বলে বসেন, সোবার্স গায়ানায় ঢুকতে পারবেন না। ইন্দিরা গান্ধী বিবৃতি দেন, সোবার্সকে বাদ না দিলে ১৯৭১ সালে ভারতের যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর রয়েছে তা বাতিল হবে। জামাইকার পক্ষ থেকে সোবার্সের পদত্যাগ চাওয়া হয়। গায়নায় টেস্ট না হলে, বা সোবার্স বাদ পড়লে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঐক্য ক্ষুণ্ন হবে এমনটা ভাবা শুরু হয়।
অবশেষে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর প্রধানমন্ত্রী এরিক উইলিয়াম চিঠি (মুচলেকা)লিখে ওয়েসলি হলের হাত দিয়ে পাঠালে সোবার্স তাতে সই করে দেন ও এই সমস্যা সমাধান হয়। ভারতও ১৯৭১-এর সফরে যায় এবং সেই সফরেই উত্থান হয় সুনীল গাভাসকার নামে এক যুবকের। তবে সোবার্সের এই পদক্ষেপ ’৮০ র দশকের দক্ষিণ আফ্রিকায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের রেবেল টুরের পথ খুলে দেয়।