১৯৪৮-এর ওভাল থেকে ১৯৯০-এর ওল্ড ট্র্যাফোর্ড
ময়ূখ লাহিড়ীদৃশ্য একঃ ১৯৪৮-এর অ্যাশেজ। পঞ্চম টেস্ট। জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংস খেলতে নামছেন পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির জনৈক অস্ট্রেলীয়। চিরশত্রু দলের অধিনায়ককে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাচ্ছে ওভালের গোটা গ্যালারি। ব্রিটিশ লেগস্পিনার এরিক হোলিসের গুগলি। ফ্রন্টফুটে খেলতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে বোল্ড স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান।
দৃশ্য দুইঃ ১৯৯০-এর ওল্ড ট্র্যাফোর্ড। ইংল্যান্ড-ভারত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্ট। প্রথম টেস্টের মতো দ্বিতীয় টেস্টেও হারের মুখে আজহারের ভারত। লক্ষ্য ৪০৮ রান। জিততে গেলে বিশ্বরেকর্ড গড়তে হবে। এই অবস্থায় খেলতে নেমে স্কোরবোর্ডে ১২৭/৫। সিরিজ জয়ের গন্ধ পেয়ে গিয়েছেন গ্রাহাম গুচ। অ্যাঙ্গাস ফ্রেজার আর এডি হেমিংসকে দিয়ে প্রতিনিয়ত ভারতকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেই ব্যাকফুটকেই অস্ত্র বানিয়ে পাল্টা আঘাত হানছেন বছর সতেরোর এক বিস্ময় প্রতিভা। মুহুর্মুহু তাঁর ব্যাট থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক ব্যাকফুট কভার ড্রাইভ। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একবার রবিন স্মিথ টিপ্পনীও কেটে গেলেন, “তোমার থেকে তো তোমার ব্যাটের ওজন বেশি! তুলছ কি করে!” যাবতীয় টিপ্পনীর জবাব দিয়ে যখন ক্রিজ ছাড়ছেন তখন গুচের মুখে হতাশার ছাপ প্রবল। আর শচীন তেন্ডুলকর নামের সেই বিস্ময় প্রতিভার নামের পাশে তখন ১১৯ অপরাজিত।
ক্রিকেটদেবতা দু’টি ঘটনার জন্য একটিই তারিখ বরাদ্দ রেখেছিলেন। ১৪ আগস্ট। উপমহাদেশের মতো ক্রিকেটের ভবিষ্যতেও বিরাট রদবদলের দিন। স্যার ডনের প্রস্থান আর আধুনিক ডনের উত্থানের মাঝে কেটে গিয়েছে ৪২ বসন্ত। কিন্তু যেখানে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া সেখান থেকেই পুনর্জন্ম নিয়েছে ২২ গজের ফিনিক্স পাখি।
অবসর নেওয়ার পরে ক্রিকেট থেকে কিছুটা দূরেই থাকতেন স্যার ডন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী জেসি নিয়মিত ক্রিকেটের খোঁজখবর রাখতেন। একদিন টিভি-তে শচীনের খেলা দেখতে দেখতে ডনকে বলেছিলেন, "দেখো, এই ছেলেটা অনেকটা তোমার মতো খেলে।“ শুনে নড়েচড়ে বসেছিলেন ডন। মন দিয়ে দেখেছিলেন মাস্টার ব্লাস্টারের ব্যাটিং। তারপর জেসির কথাতেই সায় দিয়েছিলেন।
সত্যিই তো! অধ্যাবসায়, খেলার ধরন, মাঠের বাইরের জীবন – সবেতেই আশ্চর্যরকম মিল দু’জনের। ডন বাড়ির জলের ট্যাঙ্ককে ব্যবহার করতেন ব্যাটিং অনুশীলন করার জন্য। তবে ব্যাটের বদলে হাতে থাকত স্টাম্প। যাতে ব্যাটের মাঝখান দিয়ে শট খেলতে সমস্যা না হয়। আর মারতেনও এমনভাবে যাতে বল তাঁর কাছেই ফিরে আসে। যাতে বল কুড়িয়ে আনতে গিয়ে মনঃসংযোগে ব্যাঘাত না ঘটে। আর শচীন? ১০০ আন্তর্জাতিক শতরানের পরেও তাঁর কাছে সবচেয়ে দামি ১৩ টি এক টাকার কয়েন। ছোটবেলায় শচীন যখন ব্যাট করতেন তখন তাঁর কোচ রমাকান্ত আচরেকর স্টাম্পের উপর একটি এক টাকার কয়েন রেখে দিতেন। শচীনকে আউট করতে পারনে কয়েন পাবে বোলার। আর না আউট করতে পারলে কয়েন থাকবে শচীনের কাছেই।
শট বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দু’জনের পছন্দ অনেকটা একইরকম। দু’জনেই শট বাছাই করতেন বোলারের নাম দেখে নয়, বল দেখে। ফুটওয়ার্ক? সেখানেও আশ্চর্য মিল! বিশেষত, লেগ গ্লান্স, স্কোয়্যার কাট, স্কোয়্যার ড্রাইভ আর পুলের ক্ষেত্রে। ডনের আমলে বোলারদের স্ট্র্যাটেজি ছিল, ক্রমাগত অফ স্টাম্প বা তার বাইরে বল করতে থাকো। ব্যাটসম্যান বিরক্ত হয়ে একসময় নিজেই খোঁচা দেবে। কমে যাবে রান তোলার গতিও। সেই স্ট্র্যাটেজি ভোঁতা করতেই ডন অফ স্টাম্প লাইনের বলকে পুল করা আরম্ভ করেছিলেন। আর শচীন একই জিনিস রপ্ত করেছিলেন তাঁর আইডল ভিভ রিচার্ডসকে দেখে।
মাঠের বাইরের সময়টা দু’জনেই কাজে লাগাতেন পরের দিনের প্রস্তুতির জন্য। আর খেলা না থাকলে? দু’জনের কাছেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাঁদের পরিবারকে নিয়ে সময় কাটানো।
যতই ৪২ বছরের দূরত্ব থাকুক না কেন, ১৪ আগস্ট থেকে গিয়েছে প্রস্থান আর উত্থানের দিন হয়েই।