শাকুর রানার পরিবারে বড় হয়েছিলেন ভারতের প্রথম টেস্ট শতরানকারী
সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়নব্বইয়ের দশকে দূরদর্শনে একটি ধারাবাহিত সম্প্রচারিত হত। ‘আজনবী’। সেই সিরিয়াল বা ধারাবাহিকে একটি খল চরিত্র ছিল। নাম শকুর রানা। নিন্দুকে বলে এক কুখ্যাত পাকিস্তানি আম্পায়ারের প্রতি বিদ্বেষবশত সেনা, কাশ্মীর ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত ধারাবাহিকে এই চরিত্রটি তৈরি হয়েছিল। সেই আম্পায়ারের নামও ছিল শকুর রানা।
নিন্দুকে কোনওদিন বলবে না যে লাহোরের এই রানা পরিবারের তত্ত্বাবধানে বড় হয়ে উঠেছিলেন এক ক্রিকেটার। যিনি নিজে হিন্দু, পাঞ্জাবিভাষী, নাম নানিক অমরনাথ ভরদ্বাজ। অর্থাৎ গোটা ভারতের আদরের ‘লালা’।
এই লালাই ১৯৩৩-৩৪ মরশুমে বম্বের প্রথম টেস্টে জিমখানা মাঠে দিব্যি সেঞ্চুরি করে বসলেন। পরবর্তী প্রায় তিন দশকব্যাপী ক্রিকেটার, অলরাউন্ডার, অধিনায়ক, নির্বাচক ইত্যাদি ভূমিকায় তাঁকে দেখে যে কেউ বলতে পারে ‘ভেখিয়া পেশোর ভাই/ঘুমিয়া লাহোর ভাই/তেরে জিয়া কোই হোর নই’ অর্থাৎ পেশোয়ার দেখেছি,লাহোর দেখেছি, তোমার মতো কাউকে দেখিনি।
শোনা যায়, লাহোরের ক্রেসেন্দ্রা ক্লাবের হয়ে লালার খেলা আশির দশক অবধি পাকিস্তানের ক্লাব ক্রিকেটে কিংবদন্তির মতো ছিল। ওয়াগার ওপারেও ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে তাঁর জন্য ছিল একইরকম সম্মান। শচীন তেন্ডুলকরের অভিষেক সফরে ম্যানেজার নিযুক্ত হয়েছিলেন গায়কোয়াড় রাজপরিবারের এক সদস্য। তিনি নিজের খুশিমতো একটি গাড়িতে উঠতে গেলে গাড়ির ড্রাইভার সোজা বলেছিলেন, “এই গাড়ি লালাজির জন্য। আপনি অন্য গাড়ি দেখুন।“
লাহোরের ক্রেসেন্দ্রা ক্লাবেই খেলতেন আর এক ক্রিকেটার। লালার থেকে জুনিয়র। নাম আব্দুল হাফিজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই ভারত টেস্ট খেলতে বিলেত পাড়ি দেয়। সেই দলে তিনিও ছিলেন।
১৬ আগস্ট, ১৯৪৬। জিন্নার আহ্বানে ‘ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডেজ’ পালিত হচ্ছে। দেশজুড়ে দাঙ্গা চলছে। অন্যদিকে, বিলেতের মাটিতে ১৭ আগস্ট ওভালে শেষ টেস্টে শেষবারের মতো অবিভক্ত ভারত টেস্ট খেলতে নামছে। পতৌদির নবাব ইফতিকার আলি খান, হিন্দোলকর এবং পরবর্তীতে বিলেতের নাম করা কোচ আলফ গ্রোভারও শেষ টেস্টে নামলেন। এদিকে, দেশে যখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তছনছ তখন বিজয় মার্চেন্ট আর মুস্তাক আলির প্রথম উইকেট ইংরেজদের সমস্যায় ফেলেছে।
না, লালা বা আব্দুল হাফিজ এই ম্যাচে সফল হননি। টেস্ট ড্র হয়। প্রায় এক মাস বাদে ভারত যখন জাহাজে উঠছে দেশে ফিরবে বলে, খেলোয়াড়দের মনে আতঙ্ক, দেশে কী চলছে?
রয়ে গেলেন শুধু আব্দুল হাফিজ। অক্সফোর্ডে পড়াশোনার জন্য। বন্দরে সকলকে বিদায় জানাতে এসে তিনি কেঁদে ফেললেন। আর একসঙ্গে এক দেশের হয়ে খেলা হবে না।
এক বছর পরে যখন দাঙ্গাপীড়িত পাঞ্জাব থেকে লালা পালিয়ে আসছিলেন, দাঙ্গাকারীদের সামনে পড়ে তাঁর জীবনসংশয় হয়ে যায়। একজন চিনতে পেরে তাঁকে বাঁচিয়ে দেন।
এদিকে প্লেন ভাড়া না পেয়ে ১৯৪৭/৪৮ এর অস্ট্রেলিয়া সফরে সুযোগ পেয়েও খেলতে পারলেন না হাফিজ। সঙ্গে ফজল মামুদ।
এরপর অনেক জল সিন্ধু আর বিপাশা দিয়ে বয়ে গিয়েছে। ১৯৪৮-৪৯ মরশুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভারত সফরে এসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বেসরকারি টেস্ট খেলল। ১৯৪৯-৫০ মরশুমে কমনওয়েলথ আর ১৯৫১-৫২ মরশুমে এমসিসিও খেলল ভারতে। আর বিসিসিআই-এর চাপে আইসিসি পাকিস্তানকে টেস্ট-খেলিয়ে দেশের মর্যাদা দিল। ১৬ অক্টোবর, ১৯৫২। দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় ভারত ও পাকিস্তান মুখোমুখি। টস করতে নেমেছেন ক্রেসেন্দ্রা ক্লাবের একদা দুই সতীর্থ – লালা অমরনাথ ও আব্দুল হাফিজ। তাঁর নামের সঙ্গে তখন ‘কারদার’ যোগ হয়েছে।
১৯৫৪-৫৫ মরশুম। পাকিস্তানে টেস্ট খেলতে গিয়েছে ভারত। ম্যানেজার লালা। একদিন লাহোরের হোটেলে লবি দিয়ে যাওয়ার সময় লালার কানে কিছু অদ্ভুত সন্দেহজনক কথা ভেসে আসে একটি ঘর থেকে। কৌতুহলি ও আশ্চর্য হয়ে লালা ঘরের দরজা ঠেলা দিয়ে খুলে দেখেন কারদার ও এক আম্পায়ার মিলে পরামর্শ করছে কীভাবে ভারতের আবেদনে সাড়া দেবে না, কিন্তু পাকিস্তানের নূন্যতম আবেদনেই আম্পায়ার আঙুল তুলে দেবেন। অতঃপর যা হওয়ার হল। রগচটা লালা ওখানেই চিৎকার শুরু করে দিলেন। প্রায় হাতাহাতি লাগবার পরিস্থিতি। কোনওমতে সামাল দেওয়া গেল। কেউ কেউ বলেন, তার আগে লালা হাত চালিয়ে দিয়েছিলেন।
দেশ, কাল, পরিস্থিতি, রাজনীতি বদলে দিল একদা দুই সতীর্থকে।