আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় ‘ক্যাপ্টেন কুল’-এর
ময়ূখ লাহিড়ী১০ জুলাই, ২০১৯। ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে জড়ো হয়েছেন বিশ্বের তাবড় তাবড় প্রাক্তন ক্রিকেটার। উদ্দেশ্য, ৭০ বছরের জন্মদিনে সুনীল গাভাসকারকে অভিন্দন জানানো। কিন্তু ধারাভাষ্যকারদের বক্সে ঘনঘন নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে যাচ্ছেন সানি? হাতের নখের আর অল্পই অবশিষ্ট রয়েছে। পারবে মাহি? আরও একবার? দেশ জিতলে তবেই না জন্মদিন উদযাপন!
সানি যাঁর উপর বাজি রেখেছেন তিনিও জন্মদিনের সেলিব্রেশনটা তুলে রেখেছেন। যা দিন তিনেক আগেই পেরিয়ে গিয়েছে। তাতে কি! ১০ বলে ২৫ রান চাই। দেড় দশকের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে এরকম অসংখ্য ম্যাচ বের করেছেন তিনি। লকি ফার্গুসনের বাউন্সার। হুক করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যাটে লাগল না ঠিকমতো। ৩৮ পেরিয়েও অসামান্য ক্ষিপ্রতায় নিলেন প্রথম রান। পূর্ণ হল অর্ধশতরান। কিন্তু ব্যাট তোলার সময় নেই। স্ট্রাইক ফিরে পেতে হবে। প্রাণপণ দৌড়লেন দ্বিতীয় রানের জন্য। কিন্তু ডিপ ফাইন লেগ থেকে এসে বল কুড়িয়ে নিয়েছেন মার্টিন গাপটিল। সরাসরি থ্রো। আর মাহি? কাপ আর ঠোঁটের মাঝখানে যতটুকু ফাঁক থাকে, ক্রিজ থেকে তাঁর ব্যাটের দূরত্বও ঠিক ততটুকুই।
নয়ের দশকের শেষ দিকে এক নরম পানীয়ের বিজ্ঞাপনের স্লোগান ছিল ‘ইয়েহি হ্যায় রাইট চয়েস’। টিন-এজার ধোনি নিশ্চয়ই দেখেছিলেন সেই বিজ্ঞাপন। বাছাই করতে তাঁর সময় লাগত না। কিন্তু দ্বিতীয় রানের সিদ্ধান্তে সেদিন সামান্য ভুল হয়ে গিয়েছিল। তাই জীবনে প্রথমবার দু’দিন ধরে খেলা ম্যাচই হয়ে থাকল তাঁর জীবনের শেষ ‘একদিনের’ ম্যাচ।
অথচ, জীবনের অন্য ক্ষেত্রে কিন্তু বাছাই করতে ভুল হয়নি মাহির। রাঁচিতে বাবা পান সিং-এর সামান্য চাকরি। বাবা-মা, তিন ভাই-বোনের অভাবের সংসারে বড় হয়ে ওঠা। সেখান থেকে খেলার সুবাদে দক্ষিণ-পূর্ব রেলওয়েতে চাকরি। সেরসা স্টেডিয়ামে অনুশীলন। খড়গপুর স্টেশনে টিকিট কালেক্টরের নিশ্চিন্ত চাকরি। ক্রিকেটের টানে সেই চাকরির পরোয়া না করা। ২০০৪-এর শেষে বাংলাদেশ সফরে সুযোগ। প্রথম ম্যাচে শূন্য। পরের দু’ম্যাচে সাকুল্যে ১৯ রান। তিন মাস দলের বাইরে। ফিরে আসার পর দ্বিতীয় ম্যাচেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৪৮ রানের সেই চোখধাঁধানো ইনিংস। মহেন্দ্র সিং ধোনি থেকে ‘মাহি’ হয়ে ওঠা।
১ ডিসেম্বর, ২০০৬। জোহানেসবার্গ। টি-২০ ক্রিকেটে ভারতের অভিষেক ম্যাচ। সমালোচকরা বলেছিলেন, এসব ম্যাচ ধোনির মতো খেলোয়াড়দের জন্যই তৈরি করা। ব্যাকরণের বালাই নেই। ধুমধাড়াক্কা পেটাবে। কোথায় কি! শার্ল ল্যাঙ্গভেল্ডের বলে অফস্টাম্প গড়াগড়ি। ২০০৭ সালের টি-২০ বিশ্বকাপের আগে আর এক চ্যালেঞ্জ। টি-২০ ক্রিকেটে তরুণদের সুযোগ দেওয়ার জন্য সরে দাঁড়ালেন দলের সিনিয়ররা। প্রথমবার অধিনায়ক ধোনি। সঙ্গে তরুণ ব্রিগেড। দলের টি-২০ অভিজ্ঞতা বলতে জো’বার্গের ওই একমাত্র ম্যাচ। তাতে কি! দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াকে ছিটকে দিয়ে ফাইনালে ধোনির ভারত। এবার প্রতিপক্ষ পাকিস্তান। সেখানেও বাজিমাত ধোনির। শুরু ‘মাহি’ থেকে ‘ক্যাপ্টেন কুল’ হয়ে ওঠা।
সেই বছরই ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর ইংল্যান্ড থেকে সিরিজ জিতে এসে নেতৃত্ব ছেড়েছিলেন দ্রাবিড়। অধিনায়ক হওয়ার প্রস্তাব গিয়েছিল শচীনের কাছে। কিন্তু মাস্টার ব্লাস্টার দেখিয়ে দিয়েছিলেন মাহিকে। অথচ অস্ট্রেলিয়া সফরের ত্রিদেশীয় সিরিজে সেই শচীনকেই কার্যত ‘বাদ’ দিয়েছিলেন মাহি। ধোনির সাফ যুক্তি ছিল, একই ম্যাচে শচীন, সেহবাগ আর গম্ভীরকে খেলানো যাবে না। কারণ, তাঁরা মন্থর ফিল্ডার। অতএব, রোটেশন। তিনজনের মধ্যে দু’জনের বেশি একই ম্যাচে খেলতে পারবেন না। বিসিসিআই-এর উত্তরাঞ্চল আর পশ্চিমাঞ্চল লবি অপেক্ষায় ছিল ধোনিকে পেড়ে ফেলার জন্য। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন মাহি। ফাইনালের দুই ম্যাচেই মাহির তুরুপের তাস হয়ে দেখা দিয়েছিলেন শচীন।
এখান থেকেই ভারতীয় ক্রিকেটে ধোনি যুগ শুরু। সৌরভের মতো আবেগপ্রবণ নন, দ্রাবিড়ের মতো স্তিমিত নন। হার-জিত নির্বিশেষে নির্লিপ্ত এক অধিনায়ক। যিনি মানসিকভাবে দলের সামনে থাকেন। আসলে পুরো স্ট্র্যাটেজি বাতলান উইকেটের পিছন থেকে। বিপক্ষ ব্যাটসম্যানের অগোচরে বদলে যায় ফিল্ডিং সাজানো। আবার এই ধোনিই ব্যাট হাতে বিপক্ষের পকেটে ঢুকে যাওয়া ম্যাচ বের করতে পারেন। নেপথ্যে থাকে হাত আর চোখের অবিশ্বাস্য মেলবন্ধন, ঈশ্বরপ্রদত্ত রিফ্লেক্স আর হেলিকপ্টার শটের মতো উদ্ভাবন। কখনও সঙ্গে যুবরাজ, কখনও কোহলি, কখনও বা ভাবশিষ্য রায়না।
টিম ইন্ডিয়ার অন্দরমহলে কান পাতলে শোনা যায়, ধোনিকে নিয়ে বিস্তর লোকের বিস্তর অভিযোগ। সিনিয়রদের কাটা-কাটা কথা বলতে দু’বার ভাবেন না। রায়নার মতো কয়েকজনকে নিয়ে ‘লবি’ তৈরি করছেন। অধিনায়কত্ব নিয়ে যুবির সঙ্গে তাঁর ঠান্ডা লড়াই রয়েছে। আরও কত কি!
কিন্তু এই ধোনিই যুবির থেকে তাঁর সেরাটা বের করে নিয়েছিলেন ২০১১ বিশ্বকাপে। এই ধোনিই সৌরভের বিদায়ী টেস্টে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন নেতৃত্ব। এই ধোনিই ২০১১-এর ইংল্যান্ড সফরে রাহুল দ্রাবিড়কে সম্মানজনক প্রস্থানের রাস্তা দেখিয়েছিলেন।
আর মাহির টাইমিং? ২০১১ বিশ্বকাপে রানই পাননি। কিন্তু ফাইনালে হঠাৎ যুবির বদলে নিজে চার নম্বরে নামার সিদ্ধান্ত। ভারতীয় ক্রিকেটে রূপকথা হয়ে যাওয়া ছক্কা। এবং ইতিহাস। ২০১৩ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি ফাইনালেও পুঁজি ছিল মাত্র ১২৯। কিন্তু সেখান থেকেও জয় হাসিল করেছিলেন, ইংল্যান্ডকে দু’রানে হারিয়ে। সমালোচকরা বলেন, অধিনায়কত্বের জন্যই ম্যাচ সেরার পুরস্কার পেতে পারতেন ধোনি। যে সময় বুঝেছেন, পাঁচ দিনের ম্যাচের ধকল শরীর নিতে পারছে না, নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন টেস্ট থেকে। ২০১৫ বিশ্বকাপের পরই বুঝতে পারছিলেন, দলের নতুন থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রয়োজন। বিরাটকে তৈরি হওয়ার সূযোগ দিয়েছিলেন। ২০১৮ তে ছেড়েছিলেন টিম ইন্ডিয়ার নেতৃত্ব। ২০১৯ বিশ্বকাপে নেমেছিলেন সেই বিরাটেরই দলের সদস্য হয়ে। সেই মাহি, যাঁর ক্যাবিনেটে সমস্ত আইসিসি ট্রফি শোভা পাচ্ছে।
কিন্তু এহেন ধোনি টাইমিং-এ হঠাৎ এমন গণ্ডগোল করলেন কেন? কী এমন হল যে ৪০২ দিন ক্রিকেট থেকে দূরে থাকার পর অবসরের সিদ্ধান্ত নিতে হল? সম্ভবত, ২০২০ টি-২০ বিশ্বকাপ খেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু করোনা অতিমারীর জেরে টি-২০ বিশ্বকাপ পিছিয়ে যাওয়ায় সেই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে গেল। থেকে গেল কিছু পরিসংখ্যান। ৯০ টেস্টে ৪৮৭৬ রান, ৩৫০ একদিনের ম্যাচে ১০৭৭৩ রান, ৯৮ টি-২০ আন্তর্জাতিকে ১৬১৭ রান। উইকেটের পিছনে বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ (৮২৯) শিকারি।
তাঁর বায়োপিকে যিনি মাহির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সেই সুশান্ত সিং রাজপুত অস্তাচলে গিয়েছেন দু’মাস আগে। স্বাধীনতা দিবসে সন্ধে ৭টা ২৯ মিনিটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে অস্ত গেলেন মহেন্দ্র সিং ধোনিও।