ঘরোয়া ক্রিকেটে একাধিকবার মুখোমুখি হয়েছেন চুনি গোস্বামী ও সুনীল গাভাসকর। এবার পয়লা বৈশাখ মোহনবাগান ক্লাবে চুনির নামাঙ্কিত গেট উদ্বোধন করতে করতে আসছেন সানি। তার আগে স্পোর্টিওয়ার্ল্ডের পাঠকদের জন্য রইল ক্রিকেট মাঠে তাঁদের দ্বৈরথের গল্প।
সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়
অনন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করল মোহনবাগান ক্লাব। আগামী পয়লা বৈশাখ ক্লাবের গেট উদ্বোধন করতে আসছেন কিংবদন্তি ভারতীয় ওপেনার ব্যাটার প্রাক্তন অধিনায়ক লিটল মাস্টার সুনীল গাভাসকর। সেই গেট যার নামাঙ্কন করা হয়েছে আরেক বিরাট ক্রীড়াবিদ চুনি গোস্বামীর নামে।
এই গ্রহের টেস্টের প্রথম দশ হাজারি ব্যাটার আসছেন সেই ক্লাবের গেট উদ্বোধনে যাদের ক্রিকেটীয় কৃতিত্ব একেবারেই কম নয়। বিজয় হাজারে, ভিনু মানকড়, মুস্তাক আলি থেকে জাভাগল শ্রীনাথ, চামিন্ডা ভাস হয়ে বিরাট কোহলি পর্যন্ত মহান ক্রিকেটাররা খেলে গেছেন এই ক্লাবের জার্সিতে। অজস্র কিংবদন্তি বাঙালি ক্রীড়াবিদ, গোষ্ঠ পাল (ক্রিকেটও খেলতেন) থেকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, ঋদ্ধিমান সাহা, মহম্মদ শামি সবাই খেলেছেন মোহনবাগান দলে। তাই ক্লাবের মুকুটে এ এক নতুন পালক।
চুনি গোস্বামী ও সুনীল গাভাসকর। একজনের যদি হয় ১৯৬২ জাকার্তা, তাহলে অন্যজনের নামে আছে টেস্টে ১০,০০০ রান। একজন ফিরিয়ে দিয়েছেন বিদেশে খেলার ডাক, মোহনবাগান ছাড়বেন না বলে। অন্যজনের নামে আছে প্যাকার সিরিজ প্রত্যাখ্যানের সাহস। একজন এশিয়ার ব্রাজিল ঘুমন্ত ফুটবল দৈত্যের অধিনায়ক, অন্যজন দেখিয়েছিলেন মাত্র আড়াই দশক আগের ঔপনিবেশিক প্রভুদের তাদেরই খেলায়, তাদেরই মাঠে হারানো যায়। কিন্তু কোনোদিন কি মুখোমুখি হয়েছেন এঁরা?
হ্যাঁ। সে ঘটনাও আছে। সেটা ১৯৭১/৭২ মরশুম। গাভাসকরের টেস্ট অভিষেক হয়ে গিয়েছে। চুনি তখন ফুটবল ছেড়ে চুটিয়ে ক্রিকেট খেলছেন। বাংলার অধিনায়ক। ঠিক যেভাবে একদিন তীর্থপতি, আশুতোষ কলেজ, কলকাতা বিশ্বদ্যালয়, মোহনবাগানের ক্রিকেট ও ফুটবল দলের অধিনায়ক হয়ে ফাইনাল খেলেছেন, তেমনই বাংলার অধিনায়ক হয়ে সন্তোষ ট্রফি ও রঞ্জির ফাইনালে অধিনায়ক হয়েছেন।
২১ এপ্রিল, ১৯৭২। ব্রেবোর্নে বাংলা মুখোমুখি বম্বের। তিনবছর আগে এই ব্রেবোর্নে এইরকম রঞ্জি ফাইনালে ৯৬ ও ৮৪ করে সেঞ্চুরির পাশাপাশি ট্রফিও হাতছাড়া করেছিলেন চুনি। ভিনু মানকড় প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন তাঁর ওপর। এবারে নিজে অধিনায়ক। অজিত ওয়াদেকরের বম্বে টসে জিতে ব্যাটিং নিয়ে প্রথম দিনের শেষে ২৬৩/৩। সুব্রত গুহ রমানাথ পার্কারকে (২৭) দলীয় ৪৩ রানে ফেরত পাঠালেও ওয়াদেকরকে (৫৭) নড়ানো যায়নি বম্বের স্কোরবোর্ডে ১৬৪ রান না ওঠা অবধি। দিলীপ সরদেশাই (৩৭) রয়ে গেলেন ২৫৯ অবধি। একটা দিক ধরে রাখলেন গাভাসকর (১৩৯ ব্যাটিং)। অন্য দিকে আরেক মানকড়, অশোক শূন্য রানে ব্যাটিং।
২২ এপ্রিল, ১৯৭২। গাভাস্কার (১৫৭) ও অশোক মানকড়কে (৪২) সুব্রত গুহ ফেরানোর পরে সমর চক্রবর্তী (চাকু) ও দিলীপ দোশি বাকিদের চটজলদি প্যাভিলিয়নের রাস্তা দেখান। বম্বে ৩৭৭ রানে শেষ। সুব্রত গুহ, দোশি ও সমর চক্রবর্তী তিনটি করে উইকেট।
কল্যাণ চৌধুরী (২১) ও গোপাল বসু প্রথম উইকেটে ৬০ রান তুললেও, রুসি জিজিবয় (০) আউট হওয়ায় বাংলা দিনের শেষে ৮৯/২। গোপাল বসু ৫৪ ও অম্বর রায় ৭ রানে ব্যাটিং।
২৩ এপ্রিল, ১৯৭২। গোপাল বসু যখন ৭৩ করে আউট হলেন মিলিন্দ রেগের বলে বাংলা তখন ১৩৩। নামলেন অশোক গন্দোত্রা। তিনি ও অম্বর রায় (৪৯) মিলে ১৯৩/৩ অবধি পৌঁছে দিলেন। তখনও দল পিছিয়ে ১৮৫ রানে। হাতে সাত উইকেট। দুই সেট ব্যাটার ক্রিজে।
মিলিন্দ রেগে গাভাসকরের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। ছোটবেলা থেকে গলি, পাড়া, স্কুল, কলেজ, ক্লাব, রাজ্য (সিনিয়র/জুনিয়র) সব দলে সানির সঙ্গে খেলেছেন একইসঙ্গে। কেবল টেস্ট বা একিদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয়নি। ডান হাতি অফ ব্রেকের (অম্বর রায়ের জন্য লেগ ব্রেক) ফ্লাইট মিস করলেন অম্বর। শরদ হাজারে (গত বছর প্রয়াত হয়েছেন) সঙ্গে সঙ্গে স্টাম্প করলেন। বাংলা ১৯৩/৪।
নামলেন চুনি। নিজে লেগব্রেক করতেন। ঠিক টিচ ফ্রিম্যানের স্টাইলে। ব্যাটিং করতেন। রঞ্জিতে সেঞ্চুরি ছিল। কিন্তু সেই দিনটা তাঁর ছিল না। রেগের বলে স্লিপে তাঁর ক্যাচ ধরলেন সুনীল গাভসকর। এই সেই হাত যা ১৯৮৭ অবধি টেস্টে ১০৮ টি ক্যাচ ধরবে। বিশ্বস্ত স্লিপ ফিল্ডারের হাত।
ধ্বস নামল বাংলা দলে। ২৭৯ রানেই শেষ। ব্রাজিল-জাত অশোক গন্দোত্রা ৯২। রেগে আর শিভালকর তিনটি করে উইকেট নিলেন।
দ্বিতীয় ইনিংসে বম্বে ২৫৪ করে। গাভাস্কার মাত্র পাঁচ রান করলেও অশোক মানকড় ৯৮ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে শিভালকর (৬/৪৩) দাঁড়াতেই দেননি বাংলাকে। এবারও চুনি (৫) রেগের বলে বোল্ড।
যদিও সেবারই শুধু নয়। এর আগে ১৯৬৮/৬৯ এর ফাইনালে গাভাসকর দলে না থাকলেও অতিরিক্ত তিনজনের একজন ছিলেন। তাছাড়া ১৯৭১/৭২ মরশুমেই দলীপ ট্রফির খেলায় পশ্চিমাঞ্চলের হয়ে জামশেদপুরে গাভাসকর শতরান করেন। সেবার অশোক মানকড় আর রমানাথ পার্কারও সেঞ্চুরি করেন। চুনি করেন ২৮। উদয় যোশীর বলে (এঁর নাম গাভাসকরের আত্মজীবনী 'সানি ডেজ' এ আছে) ওয়াদেকরের হাতে ক্যাচ দিয়ে আউট হন।
৫০ বছর বাদে আসছে আবার সেই মুহূর্ত। সেই এপ্রিল। সেই চুনি ও গাভাসকর। মিশে যাচ্ছেন ষাট-সত্তরের জ্বলন্ত সময়ে তরুণ প্রজন্মের দুই আইডল। সেতুর কাজ করছে ১৩৪ বছরের প্রবীণ, কিন্তু মেজাজে চিরনবীন 'মোহনবাগান '।
বৈশাখের কলকাতায় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি হওয়া সত্বেও ক্রীড়াপ্রেমীরা এখনই গাইছেন ' এস হে বৈশাখ এস এস…'