ক্রিকেট নিয়ে শুরু হয়েছে আমাদের বিশেষ ফিচার। কলম ধরেছেন ক্রিকেট গবেষক সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়। এই কিস্তিতে তিনি লিখলেন ১৯৬২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে চার্লি গ্রিফিথের বলে নরি কন্ট্রাক্টরের মাথার হাড় ভেঙে প্রাণ সংশয়ের কাহিনি। ক্রিকেট দুনিয়ার আরও অনেক গল্প ও অজানা কাহিনি পরবর্তী কিস্তিতে।
টাইটেনিয়াম প্লেটের সঙ্গে ছয় দশকের কন্ট্রাক্ট শেষ হল কন্ট্রাক্টরের!
কেটে গেছে ষাট বছর। সেই দিনটার কথা হয়তো কোনদিনই ভুলবেন না ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটার নরিম্যান জামশেদজি কন্ট্রাক্টর। সেটা ১৯৬২ সালের মার্চ মাস। ভারত গিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। সফর যথারীতি খারাপ যাচ্ছে। জামাইকা আর ত্রিনিদাদের জুনিয়র ও সিনিয়র দুই দলকেই হারাতে ব্যর্থ ভারত। দুটো টেস্টেই হেরে বসে আছে ভারত। একটায় মাত্র ৯৮ রানে শেষ হয়েছে। একটায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৬০০ এর বেশি তুলেছে। এমন অবস্থায় বার্বাডোজে খেলতে গেলো ভারত। এরপরেই শুরু হবে তৃতীয় টেস্ট।
১৬ই মার্চ ট্যুর ম্যাচে বার্বাডোজ নামল ব্যাট করতে। স্মিথ ৬১ করে আউট হওয়ার পরে কলিস কিং ৮৭ আর ওয়েস হল ৪৪ করে অপরাজিত। দিনের শেষে বার্বাডোজ ৩১৯/৬। পরের দিন কিং ৮৯ করে আউট হলেও হল খুব পেটালেন। করলেন ৮৮ রান। বার্বাডোজ করলো ৩৯৪। এবার পালা ভারতের।
ব্যাট করতে নামলেন কন্ট্রাক্টর ও সারদেশাই। কন্ট্রাক্টর ২ রান করার পর বল করতে গেলেন গ্রিফিথ। প্ৰথম বলের পরেই সারদেশাই চিৎকার করে কন্ট্রাক্টরকে বললেন গ্রিফিথ বল চাক করেছে। কন্ট্রাক্টর বললেন আম্পায়ারকে জানাতে।
দ্বিতীয় বল শর্ট পিচড। কন্ট্রাক্টর খেলতে পারলেন না। শর্ট লেগে ক্যাচ উঠল। কিন্তু ধরা পড়ল না। ধরা পড়লে হয়তো ইতিহাস অন্য কথা বলতো। তৃতীয় বল বাউন্সার। তারপর কী হল বলা মুশকিল। কেউ কেউ বলেন নরি বলটা ডাক করার আগেই এসে যায় মাথার সামনে। কেউ কেউ বলেন (যেমন উইজডেন) নরি বলটি লাইনে গিয়ে লেগের দিকে সরাতে গিয়ে গতিতে পরাস্ত হন। বলটি ডান কানের ওপরে লাগে। তিনি বসে পড়েন। সবাই দৌড়ে আসেন। তাঁকে ধরাধরি করে প্যাভিলিয়ন এ নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ বাদে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তারেরা অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেন।
এদিকে ততক্ষনে সারদেশাই, রুসি সূর্তি প্যাভিলিয়ন এর রাস্তা ধরেছেন (ভারত ২/২)। বিজয় মঞ্জরেকর আহত হয়ে বাইরে। মাঝে মাঝে চোখে ঝাপসা দেখছেন। ভারত দাঁড়াতেই পারল না। জয়সীমা(৩৪) আর ইঞ্জিনিয়ার (৩৬) ষষ্ঠ উইকেটে ৬১ রান যোগ করে দিলে ভারত ৮ উইকেটে ৮৬ তোলে। দুজন আর ব্যাট করেননি।
এদিকে একটা অপারেশনে কাজ হয়নি। উল্টে মস্তিষ্কে রক্ত জমে সাময়িক পক্ষাঘাত হয়ে যায় কন্ট্রাক্টর এর। ডাক্তাররা আবার অপারেশন করেন। এরপরে কিছুটা সুস্থ হন তিনি। ফ্রাঙ্ক ওরেলের নির্দেশে যত দিন কন্ট্রাক্টর হাসপাতালে ছিলেন তত দিন তাঁর শুশ্রূষার দায়িত্বে ছিলেন সেমুর নার্স। কন্ট্রাক্টর সদ্য বিবাহিত এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারকে বাড়ি যেতে বললে, তিনি বলেন, ‘‘ম্যান, আমার নাম জান তো? সেমুর নার্স। এখানে আমার কাজ তোমার নার্স হিসেবে কাজ করা। আমার ক্যাপ্টেন ওরেল, এই নির্দেশ দিয়েছেন। তুমি সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমার ছুটি নেই।’’ তিনি হাসপাতালেই পড়ে থাকতেন কন্ট্রাক্টরের শয্যার পাশে। পলি উমড়িগড়,বাপু নাদকার্নি, সাংবাদিক প্রভু ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ফ্রাঙ্ক ওরেল রক্তদান করেন কন্ট্রাক্টরের জন্য।
ভারত এদিকে দ্বিতীয় ইনিংসে ২১৩/৭ তোলার পরে ইনিংস শেষ। প্রসন্ন আহত। তিনিও ব্যাট করেননি। যদিও মঞ্জরেকার এই পিচেও ১০০ করেন। এ দিকে প্রায় ৬ দিন অজ্ঞান থাকার পর জ্ঞান ফিরে আসে নরি কন্ট্রাক্টর এর। চার্লি গ্রিফিথ অত্যন্ত মনঃকষ্ট ভোগ করছিলেন। তাঁর স্ত্রী জ্ঞান ফিরলে কন্ট্রাক্টর এর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁকে কন্ট্রাক্টর বলেন ' চার্লির কোনও দোষ নেই। আমিই বলটা খেলতে পারিনি।'
১৯৫৯ সালের ইংল্যান্ড সফরে যে কন্ট্রাক্টর কব্জির চোট সত্বেও ৮১ করেছিলেন, তিনি মাত্র ২৮ বছর বয়সে ৩১টি টেস্ট ম্যাচ খেলে কেরিয়ার শেষ করলেন। আরও এক দশক ক্রিকেট খেললেও টেস্ট আর খেলেননি।
ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরে মাদ্রাজে একটি টেম্পারেচার প্রুফ মেটাল প্লেট বসানো হয় কন্ট্রাক্টর এর মাথায়। পাক্কা ষাট বছর পরে সেই প্লেট কিঞ্চিৎ সমস্যায় ফেলেছিলো তাঁকে। ডাক্তারের পরামর্শ মেনে অবশেষে সেই প্লেট সরানো হয়েছে দিন কয়েক আগে।