১৯৩২ সালের ২৫ জুন। টেস্ট ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ ভারতের। শনিবার নব্বই বছরে পা দিল ভারতীয় ক্রিকেটের সরকারি ভাবে টেস্ট দল হিসেবে উঠে আসা। সেই অধ্যায় ঘুরে দেখলেন ক্রিকেট গবেষক সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়।
দেখতে দেখতে ৯০ বছর কেটে গেল ভারতের প্রথম টেস্ট খেলার। ভারত আর ক্রিকেট জগৎ বদলে গেল। সে সব দিন ছিল একেবারেই আলাদা। তখন ব্র্যাডম্যানের দাপট চলছে ক্রিকেট দুনিয়ায়। জ্যাক হবস সবে ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন, সাটক্লিফ তখনও খেলছেন। হোমসের (কলকাতায় জন্ম)সঙ্গে ৫৫৫ রানের জুটি গড়ে ফেলেছেন, রোডস- এর পরে পৃথিবীর অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে ফ্রাঙ্ক উলি রয়েছেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ' কালো ব্র্যাডম্যান' হ্যাডলি , নির্ভীক অলরাউন্ডার লিয়ারি কনির দাপট চলছে, সঙ্গে আছেন মার্টিনডেল।
ভারতে তখনও রাজাদের প্রভাব। তারই মধ্য দিয়ে মাথা উঁচু করে আছেন সি কে নাইডু, অল্প অল্প নাম শোনা যাচ্ছে লালা অমরনাথের। মুস্তাক আলি হবসের থেকে উপহার পেয়েছেন, হিন্দু জিমখানার হয়ে বোম্বে কাঁপাচ্ছেন বিজয় মার্চেন্ট ও এল পি জয়, বিঠ্ঠল সবে খেলা ছেড়েছেন। এমন সময় ভারত প্রথম সরকারী টেস্ট খেলে ফেললো পৃথিবীর ষষ্ঠ দেশ হিসেবে।
মজার ব্যাপার, যদি আরও তিরিশ বছর আগের কোনও খেলার স্কোর দেখে কোনও ব্রিটিশ পরিসংখ্যান ও ইতিহাসবিদ মনে করত যে এই লর্ড হক একাদশ বনাম ভারত ম্যাচটাকে টেস্ট বলে মেনে নেওয়া উচিৎ তাহলে বোধ হয় ১৮৯২-৯৩ সালে এলাহাবাদের আলফ্রেড পার্ক (বর্তমানে মদন মোহন মালব্য পার্ক) এর ম্যাচটাই প্রথম টেস্ট হয়ে যেত, এবং কোথাকার কে জন চিসনে (যদিও মোটেই কোথাকার কে নন, এঁর পিতা ছিলেন কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার , মহাবিদ্রোহের পরে দিল্লি দখলের সময় সেনা দলে ছিলেন [গালিবের "দস্তম্বু" গ্রন্থে এর কিছু বর্ণনা আছে] , প্রথম আবিস্কারক সাহিত্য ও কল্পবিজ্ঞানের সূত্রপাতকারী উপন্যাস The Battle of Dorking: Reminiscences of a Volunteer এর লেখক) ভারতের প্রথম অধিনায়ক হয়ে যেতেন। কিন্তু সেটা হয়ে যায় বেসরকারি টেস্ট, দলে তিনজন ভারতীয় ছিলেন।
এর প্রায় ১০ বছর বাদে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি অথেনটিক্স দলের বিরদ্ধে জেন্টলম্যান অফ ইন্ডিয়া একটা বেসরকারি টেস্ট খেলে। আরও ৯ বছর বাদে ভারতীয় দলের প্রথম ইংল্যান্ড সফরে এম সি সি দলের বিরদ্ধে আরও একটা বেসরকারী টেষ্ট খেলে ভারত।
এরপরে আর্থার গিলিগানের এম সি সি ভারতে খেলতে এসে দুটো বেসরকারী টেষ্ট খেলে এবং এম সি সি কে প্রস্তাব দেয় ভারতকে টেষ্ট স্ট্যাটাস দিতে। এম সি সির পরামর্শে ভারত ক্রিকেট বোর্ড বানায় ও ১৯৩০ সালে পুনরায় এম সি সি ভারতে এলে টেষ্ট খেলবে বলে স্থির হয়।
কিন্তু আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হলে তাঁরা পিছিয়ে যান ও স্থির হয় যে ভারতই ১৯৩২ এ ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে সফরে যাবে। ইতিমধ্যে ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজকুমার ভিজি' র টাকায় ভিজিয়ানাগ্রাম একাদশ ভারত সফর করে হবস, সাটফ্লিককে নিয়ে।
কিন্তু ১৯৩২ সালে একাধিক সংকট দেখা যায়। প্রথমেই বোম্বে জিমখানা আইন অমান্য আন্দোলনকে সমর্থন করে মার্চেন্ট ও এল পি জয়কে বিদেশে সফরের অনুমতি দেয়নি। এরাও ভারতীয় নেতাদের মুক্তির দাবিতে সফর বয়কট করে।
এরপর সফরে অধিনায়ক কে হবে তাই নিয়ে বিতর্ক তৈরী হয়। ভিজি ও পোরবন্দরের মহারাজা নটবর সিং লড়াইয়ে নামে। শেষে নটবর সিং অধিনায়ক, ভিজি সহ- অধিনায়ক ও নটবর সিং এর শ্যালক লিম্বদির রাজা ঘণশ্যামজী ডেপুটি সহ অধিনায়ক হন। ভিজি ক্ষুব্ধ হয়ে সফরে যাননি, মুখে বলেন যে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য তিনি এই মহান আত্মত্যাগ করলেন।
নটবর সিং বিচক্ষণ ছিলেন। সফরে সব মিলিয়ে ১০ টা ম্যাচ ও খেলেননি, প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেন চারটে। লিম্বদি এম সি সির বিরূদ্ধে খেললেও টেষ্ট ম্যাচে তাঁকে খেলতে বারণ করেন নটবর সিং। সি কে নাইডু কে অধিনায়ক করা হয়। এতে ওয়াজির আলি ও সমর্থকরা টেস্টের আগের দিন রাতে পরের দিন না খেলার হুমকি দিলে নটবর সিং পরিষ্কার জানান না খেললে দেশে ফেরত পাঠানো হবে, কিন্তু অধিনায়ক সি কে নাইডুই হবে।
এরপরের দিন শুরু হলো টেস্ট। কদিন আগেই ৫৫৫ রানের রেকর্ডকারি ওপেনার সহ ইংল্যান্ড মাত্র ১৯ রানে হারালো ৩উইকেট। লর্ডসে তখনও ধুলো ঝেড়ে বসতে পারেনি দর্শকরা। দিনটা ছিলো ২৫ শে জুন।
না সেই টেস্ট ভারত জেতেনি। ১৫৮ রানে হেরেছিল। মহম্মদ নিশারের ৫ উইকেট, অমর সিং এর দ্বিতীয় ইনিংসে ১০ নম্বরে নেমে ব্যাট হাতে ৫১, সর্বোপরি একটা সম্পূর্ন ব্রিটিশ শাসিত দেশের ১০০% ব্রিটিশহীন টেস্ট দল হিসেবে আত্ম- প্রকাশ ক্রিকেটে নতুন যুগের আগমন বার্তা ঘোষণা করে ছিলো।