লালা ১০৯; কাইজার অপরাজিত ৭৫
ময়ূখ লাহিড়ী৯/১১। প্রায় দু’দশক আগের এক ভয়াবহ স্মৃতির সঙ্গে সমার্থক হয়ে যাওয়া দিন। কিন্তু অনেকেই ভুলে যান, সেপ্টেম্বর মাসের ১১ তারিখ শুধুই এক অভিশপ্ত দিন নয়। বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে কিছু কালজয়ী ঘটনার স্মৃতিও। ১৮৯৩ সালে এই দিনেই শিকাগোতে ভাষণ দিয়ে বিশ্বদরবারে জায়গা করে নিয়েছিলেন বিবেকানন্দ। যাঁর সঙ্গে খেলার এক অদ্ভুত যোগাযোগ ছিল। একবার তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলেছিলেন, “গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলা অনেক ভালো।“ আর সেই ফুটবলেরই এক কিংবদন্তির জন্ম হয়েছিল এই ১১ সেপ্টেম্বর। সেটা ১৯৪৫ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ হয়ে থাকা ম্যুনিখে। জার্মান ফুটবলে যিনি রূপকথা সৃষ্টি করেছিলেন। জার্মান ফুটবলপ্রেমীরা তাঁকে ডাকতেন কাইজার বলে। আর পৃথিবীর কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন ফ্রানজ বেকেনবাওয়ার নামে।
শুধু কাইজারই নয়। ইতিহাস পালটে দেওয়া আরও এক ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়েছিল ১১ সেপ্টেম্বর। যে বছর ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে মোহনবাগান প্রথম ভারতীয় দল হিসাবে আইএফএ শিল্ড জিতেছিল, আর যে বছর বঙ্গভঙ্গের জেরে কলকাতা থেকে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী সরে গিয়েছিল দিল্লিতে, সেই ১৯১১-তেই পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন তিনি। পোশাকি নাম ছিল নানিক ভরদ্বাজ অমরনাথ। কিন্তু পেশোয়ার থেকে পাবনা তাঁকে চিনত ‘লালা’ নামেই।
দু’জনের মধ্যে বয়সের ফারাক ৩৪ বছর। কিন্তু পরিস্থিতি কিছু জায়গায় একই সুতোয় বেঁধে দিয়েছিল লাহোরের লালা আর ম্যুনিখের কাইজারকে। দু’জনেই যখন জন্মেছেন তখন তাঁদের দেশের গৌরব অস্ত গিয়েছে। পাঞ্জাবে লালা দেখেছেন, কীভাবে ধর্মের নামে বিভাজন মানুষে মানুষে লড়াই বাঁধিয়েছে। ভিতরে ভিতরে বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। রাজনীতির শিকার হয়েছেন খেলোয়াড় জীবনে। কিন্তু যাবতীয় অপমানের জবাব দিয়েছেন ২২ গজে। ১৯৩৩ সালে প্রথম ভারতীয় হিসাবে টেস্ট শতরান করেছিলেন। তাও অভিষেকেই। ১৯৩৬ সালে যখন ভারতীয় দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে যান তখন অগণিত ভারতীয়র কাছে লালা ছিলেন বিদ্রোহের প্রতীক। যিনি গোরা সাহবদের চোখে চোখ রেখে জবাব দিতে জানতেন। কিন্তু সেই সফর থেকেই ফিরে আসতে হয়েছিল। কারণ? অধিনায়ক ভিজির বর্ণবিদ্বেষী চক্রান্তে সায় দেননি। তৎকালীন ভারতীয় দলের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় সিকে নাইডুকে তাঁর গায়ের রঙ নিয়ে প্রায়ই খোঁটা দিতেন ভিজি। ১৯৩৬-এর সফরে দলের সকলের প্রতি তাঁর নির্দেশ ছিল, সিকে-কে দেখলেই বলতে হবে, “বাহার সে কালা/ অন্দর সে কালা/ বড়া শয়তান হ্যায়/ ইয়ে ইন্দোরওয়ালা”। কিন্তু সেই নির্দেশ পালন করেননি লালা। যার ফল হিসাবে কেরিয়ারের প্রথম ছ’বছরে মাত্র তিনটি টেস্ট খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। আরও অপেক্ষা। পড়ন্ত বেলায় খেলেছিলেন আরও ২১টি টেস্ট। অবসর নেওয়ার পরেও লালা ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বদের একজন। দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করেছেন ১৯৫৪-৫৫ মরশুমের পাকিস্তান সফরে। ছিলেন জাতীয় নির্বাচকের পদেও। এম এল জয়সীমা, জেসু পটেলদের কাছে লালা ছিলেন অভিভাবক। ধারাভাষ্যকার হিসাবেও লম্বা সময় কাটিয়েছেন।
কাইজারের বেড়ে ওঠাও এরকমই কিছু প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে। বাবা ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মী। তাঁর সায় ছিল না ছেলের ফুটবল খেলার বিষয়ে। কিছুটা বাবার অমতেই ফুটবল খেলা শুরু করেছিলেন ন’বছর বয়সে। ১৯৫৪ সালে। যেবার প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিল তাঁর দেশ পশ্চিম জার্মানি। বছর পাঁচেক বাদে সুযোগ পেয়েছিলেন বায়ার্ন ম্যুনিখের অনূর্ধ্ব-১৪ দলে। ক্রমশ দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু হঠাৎই ছন্দপতন। সেটা ১৯৬৩ সাল। কাইজারের বয়স তখন মাত্র ১৮। আচমকাই জানা গিয়েছিল, তাঁর তৎকালীন বান্ধবী গর্ভবতী এবং তাঁকে বিয়ে করার কোনও পরিকল্পনাই নেই বেকেনবাওয়ারের। সেই কারণেই পশ্চিম জার্মানির যুব দল থেকে বাদ পড়েছিলেন। কিন্তু সেটা যে নেহাতই পদস্খলন তা বুঝতে দেরি হয়নি কোচ ডেটমার ক্রেমারের। তাঁর হস্তক্ষেপেই দলে ফিরতে পেরেছিলেন কাইজার। এখান থেকেই তাঁর উত্থানের শুরু। ১৯৬৬ বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েই জাত চিনিয়েছিলেন। দলকে ফাইনাল পর্যন্ত নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। করেছিলেন চারটি গোল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি।
১৯৭০ বিশ্বকাপ। সেমিফাইনালে মুখোমুখি পশ্চিম জার্মানি এবং ইতালি। হাইভোল্টেজ ম্যাচে কেউ কাউকে এক ইঞ্চিও জমি ছাড়তে রাজি নয়। নির্ধারিত সময় শেষে স্কোরলাইন ১-১। কিন্তু অতিরিক্ত সময়েই তৈরি হল ইতিহাস। ৩০ মিনিটে পাঁচ গোল। ইতালি দিল তিনটি গোল। আর জার্মানরা দু’বার বল জড়াল আজ্জুরিদের জালে। কিন্তু ‘শতাব্দীর সেরা ম্যাচ’ নামে পরিচিত এই ম্যাচ স্মরণীয় হয়ে রয়েছে কাইজারের জন্যও। ম্যাচ চলাকালীন কলার বোন সরে গিয়েছিল বেকেনবাওয়ারের। কিন্তু মাঠ ছাড়েননি। স্লিং-এ হাত ঝুলিয়ে খেলেছিলেন ম্যাচের বাকি অংশ। আর চার বছর পরে তাঁর হাতেই উঠেছিল বিশ্বকাপ। দলের প্রয়োজন বুঝে নিজের জায়গা পরিবর্তন করেছিলেন। স্ট্রাইকার থেকে হয়ে গিয়েছিলেন লিবেরো। আর তাতেই বাজিমাত। তাও ফাইনালে জোহান ক্রুয়েফের অপ্রতিরোধ্য হল্যান্ডকে হারিয়ে। এরও ১৬ বছর পরে আবার জার্মানিকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছিলেন লোথার ম্যাথাউজ, য়ুর্গেন ক্লিন্সম্যানরা। তারও নেপথ্যে ছিলেন ম্যানেজার বেকেনবাওয়ার। ব্রাজিলীয় কিংবদন্তি মারিও জাগালোর পর বেকেনবাওয়ারই ছিলেন একমাত্র মানুষ যিনি অধিনায়ক এবং কোচ – দুই ভূমিকাতেই বিশ্বকাপ পেয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সেই নজির স্পর্শ করেন ফ্রান্সের দিদিয়ের দেশঁও।
৯/১১ তাই শুধুই ভয়াবহতার প্রতীক নয়। ছাই থেকে জন্ম নেওয়া ফিনিক্স পাখিদেরও দিন।