জেসি ওয়েন্সের ১০৭ বছরের জন্মদিনে স্পোর্টি ওয়ার্ল্ডের শ্রদ্ধার্ঘ্য
ময়ূখ লাহিড়ী২৫ মে, ২০২০। করোনা-আতঙ্কে তখন ঘরবন্দি মানুষ। এরই মধ্যে গোটা পৃথিবীকে নড়িয়ে দিয়েছিল মিনিয়াপোলিসের ঘটনা। যখন জর্জ ফ্লয়েড নামের জনৈক কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনীকে কার্যত খুন করেছিল সেদেশের পুলিশ। তারপরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়েছিল হ্যাশট্যাগের আন্দোলন। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’। নতুন করে মাথা চাড়া দিয়েছিল বর্ণবৈষম্যের ভূত।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফের চালু হওয়ার পরে ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ইংল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা। নতুন করে তৈরি হয়েছিল প্রতিবাদের ভাষা। ক্রিকেট মাঠে এক হাঁটু গেড়ে, ডান হাত মুঠো পাকিয়ে, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি উঠেছিল। ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড সিরিজেও দেখা গিয়েছিল একই ছবি। কিন্তু ইংল্যান্ড-পাকিস্তান এবং ইংল্যান্ড-অস্টড়েলিয়া সিরিজে বেমালুম গায়েব সেই ছবি। যা নিয়ে তীব্র ভাষায় ধিক্কার জানিয়েছেন ক্যারিবিয়ান কিংবদন্তি মাইকেল হোল্ডিং। আর অস্ট্রেলীয় অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ বলেছেন, “এভাবে প্রতীকী প্রতিবাদ করে কোনও লাভ নেই। তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন বিষয়টি নিয়ে মানুষকে শিক্ষিত করা।“
আসলে সভ্যতা বা সমাজ যতই এগিয়েছে বলে দাবি করা হোক, বর্ণবৈষম্যের ভূত কোনওভাবেই তাড়ানো যায়নি। গত ৫০ বছরে যখনই বর্ণবৈষম্যের প্রসঙ্গ এসেছে, আঙুল উঠেছে দক্ষিণ আফ্রিকার দিকে। কখনও বা জিম্বাবোয়ের দিকে। কিন্তু ঘটনা হল, বর্ণবৈষম্যের ভূত সযত্নে পুষে রেখেছে সেই দেশই যারা নিজেদের “বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্র” বলে দাবি করে এসেছে। সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যারা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়েছিল ১৭৭৬ সালে। কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গরা ভোটাধিকার পেয়েছিলেন তার প্রায় দু’শতাব্দী পরে। ১৯৬৪ সালে। যখন কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারের দাবিতে সরব হয়েছিলেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র।
তবে খেলার আঙিনায় বিপ্লব শুরু তারও অনেক আগে। সেটা ১৯৩৬ সাল। অলিম্পিকের আসর হিটলার-জমানার বার্লিনে। খেলার দুনিয়ায় আবির্ভাব হয়েছিল জেসি ওয়েন্সের। তাবড় তাবড় অ্যাথলিটদের পিছনে ফেলে জিতে নিয়েছিলেন চারটি সোনা। লং জাম্প, ১০০ মিটার দৌড়, ২০০ মিটার দৌড় এবং ৪x১০০ মিটার রিলেতে। এক ‘নিগ্রো’-র এমন কীর্তি! মেনে নিতে পারেননি ফুয়েরার। শোনা যায়, কৃষ্ণাঙ্গ ওয়েন্সের সঙ্গে করমর্দন করতেও রাজি হননি হিটলার। এমনকী, ওয়েন্সের শেষ সোনা জয়ের দিন রাগ চেপে রাখতে না পেরে স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়েও গিয়েছিলেন জার্মান রাষ্ট্রপ্রধান।
এ তো গেল নাৎসি জার্মানির ঘটনা। নিজের দেশে ফিরে কী পেয়েছিলেন ওয়েন্স? একবার সেই সময়কার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জানিয়েছিলেন, “প্রেসিডেন্ট রুসভেল্ট বার্লিন থেকে পক জিতে ফেরা সব অ্যাথলিটদের সংবর্ধনা দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সেখানে আমন্ত্রণ পাইনি। তাঁর কাছ থেকে কোনও অভিনন্দনসূচক বার্তাও পাইনি।“
অলিম্পকের আগের বছর ১৯৩৫ সালে মিশিগানে বিগ বেন ট্র্যাক মিটেও ওয়েন্সের পারফরম্যান্স ছিল চোখধাঁধানো। মাত্র ৪৫ মিনিট। তার মধ্যে গড়েছিলেন তিনটি বিশ্বরেকর্ড। ছুঁয়েছিলেন আরও একটি। কিন্তু ১৯৩৫ বা ১৯৩৬, কোনও বছরই সেরা মার্কিন অ্যাথলিটের পুরস্কারের (সুলিভান অ্যাওয়ার্ড) জন্য তাঁকে বিবেচনা করেনি প্রাচীনতম ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্র।
বঞ্চনার আখ্যান এখানেই শেষ নয়। অলিম্পিক থেকে ফেরার পর কোনও চাকরি জোটেনি তাঁর। কখনও লিফটম্যান, কখনও নিরাপত্তারক্ষী – নানাভাবে উপার্জনের চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ ছিল ঘোড়ার সঙ্গে দৌড়ে বাজি জেতা। স্টার্টিং লাইন থেকে ১০০ মিটার। একইসঙ্গে দৌড় শুরু করতেন ওয়েন্স এবং অশ্বারোহী। কিন্তু ওয়েন্স ছোটা শুরু করতেন বন্দুকের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে। আর অশ্বারোহী বন্দুকের আওয়াজ শুনে ঘোড়া ছোটানো শুরু করতেন। মাঝে যেটুকু সময় লাগত তার মধ্যেই অনেকটা এগিয়ে যেতেন ওয়েন্স। এভাবে প্রতি বাজিতে জিততেন দু’হাজার ডলার। উপার্জনের জন্য খেলতেন বেসবলও। কিন্তু কোনও জায়গাতেই থিতু হওয়া ধাতে ছিল না ওয়েন্সের। থাকবেই বা কী করে! জন্ম থেকেই তো দৌড়! অস্তিত্বের দৌড়। জীবনের দৌড়। এরকমই এক ১২ সেপ্টেম্বর আলাবামায় জন্ম হয়েছিল তাঁর। সেটা ১৯১৩ সাল। সাত বছর বয়সে দৌড়নো শুরু। কিন্তু ১৯২২ সাল নাগাদ দেখা দিল এক চরম সংকট। ওয়েন্স পরিবারের আয়ের উৎস ছিল তুলো চাষ। সেই তুলোই সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল পোকার আক্রমণে। ১৫ লক্ষ মানু্যষের সঙ্গে ওয়েন্স পরিবারও দক্ষিণ ছেড়ে চলে এল যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরে। ওহায়োতে শুরু হল জেসির নতুন জীবন। ভোরবেলা থেকে দৌড় অনুশীলন। তারপর স্কুল। তারপর জুতো সারাই আর পালিশের কাজ। সেই স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন। উত্তর এসেছিল, “জে সি ওয়েন্স।“ কিন্তু দক্ষিণ মার্কিনী উচ্চারণ বুঝতে ভুল করেছিলেন সেই শিক্ষিকা। জেমস ক্লিভল্যান্ড ওয়েন্স চিরতরে ‘জেসি’ ওয়েন্স হয়ে গিয়েছিলেন। সেখানেই তাঁর প্রতিভা চোখে পড়েছিল কোচ চার্লি রিলের। তারপর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পদক জেতা শুরু জেসির। কিন্তু কোনওদিন স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনও বৃত্তি পাননি। কারণ? গায়ের রঙ। এমনকী, কৃষ্ণাঙ্গ বলে রেস্তোরাঁ থেকেও বের করে দেওয়া হয়েছিল জেসিকে।
জীবনের শেষদিকে সামান্য হলেও সম্মান জুটেছিল ওয়েন্সের ভাগ্যে। দেশের শুভেচ্ছাদূত নিযুক্ত হয়েছিলেন। খেলার মাঠে নিজে রাজনীতির শিকার হয়েছিলেন। তাই সবসময় চেয়েছিলেন খেলাকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে। ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক। ঠান্ডা যুদ্ধের জেরে তখন সোভিয়েতের সঙ্গে অহি-নকুল সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। মার্কিন সরকার সিদ্ধান্ত নিল, দল পাঠানো হবে না মস্কোতে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল ওয়েন্সের। সেই সূত্রেই বলেছিলেন, “অলিম্পকের স্পিরিটটাই অন্যরকম। এখানে রাজনীতি না টানাই ভালো।“ শোনেনি হোয়াইট হাউস। কিন্তু সেই বছরই ওয়েন্সের মৃত্যুর পর কার্টার তাঁর শোকবার্তায় লিখেছিলেন, “অত্যাচার, দারিদ্র্য এবং বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের সবচেয়ে বড় প্রতীক ওয়েন্স।“
আশ্চর্যভাবে, সেই ১৯৮০ সালেই বাংলায় মুক্তি পেয়েছিল প্রবাদপ্রতিম হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গাওয়া ‘জন হেনরি’। সেই জন হেনরি যার লড়াই ছিল যন্ত্রের বিরুদ্ধে, যান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে। অবিকল জেসির মতোই।
কালো মানুষদের সংগ্রাম বোধহয় একইরকম হয়। যেমন, জন হেনরি। যেমন, জর্জ ফ্লয়েড। যেমন, জেসি ওয়েন্স।